শিল্পমাত্রই জীবনাশ্রয়ী। তাই যে-কোনো শিল্পকলায় সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর জীবনাচরণ কমবেশি প্রতিফলিত হয়। উপজাতীয়দের গোষ্ঠীবদ্ধ কর্মকান্ডও তাদের শিল্পকলায় প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। মূলত তাদের জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করেই উপজাতীয় নৃত্যের উদ্ভব ঘটেছে। সে আদিকাল থেকে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে তাদের লড়াই করতে হয়েছে; বনবাদাড় থেকে পশুপাখি শিকার করে খাদ্য আহরণ করতে হয়েছে। শিকারে যাওয়ার আগে পশুর ছবি এঁকে তারা দলবদ্ধভাবে শিকারের নকল করে নৃত্য করেছে। রুষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করা, জ্বরা-ব্যাধি দূর করা, ফসল উদ্গমনের আকাঙ্ক্ষায় বৃষ্টি কামনা করা কিংবা মারি-মড়ক থেকে বাঁচার জন্য তারা নানারকম আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে এবং সে সূত্রেই সৃষ্টি হয়েছে নৃত্যেরও। যুগের পরিবর্তন ও সমাজবিকাশের কারণে মানুষের কাজের পদ্ধতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যের ভঙ্গিমাও পরিবর্তিত হয়েছে। নৃত্যে হিংস্রতা ও আক্রমণাত্মক মানসিকতার পরিবর্তে স্থান পেয়েছে নান্দনিকতা। এভাবে আদি মানবগোষ্ঠীর সে আদিম নৃত্যধারা রূপান্তরের মাধ্যমে আজও প্রবহমান।
বাংলাদেশে সমতল ও সীমান্তের পাহাড়ি অঞ্চলে আদি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় ও নেগ্রিটো নরগোষ্ঠীর বংশধর মণিপুরী, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুরং, চাকমা, গারো, খাসিয়া, কোচ, হাজং প্রভৃতি শ্রেণির উপজাতি বসবাস করে। তাদের কারও কারও জীবিকা, ধর্মবিশ্বাস ও জীবনধারায় রূপান্তর ঘটলেও আমূল পরিবর্তন হয় নি। বনজঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার ও জুমচাষ আজও তাদের প্রধান জীবিকা। তারা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের নানাক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে আসছে।
প্রায় সবশ্রেণীর উপজাতিই পূজাপার্বণ, জন্মমৃত্যু, বিবাহ ও চিত্তবিনোদন উপলক্ষে নিজ নিজ পদ্ধতিতে নাচগানে মেতে ওঠে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে তারা কখনও একত্রে, কখনওবা এককভাবে নৃত্য করে; সঙ্গে থাকে নিজস্ব সঙ্গীতধারা। বাদ্যযন্ত্রগুলিও নিজেদের তৈরি। এ নৃত্য গোষ্ঠীভেদে সাঁওতাল নৃত্য, গারো নৃত্য, মণিপুরী নৃত্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। ঘরবাড়ি তৈরি, চাষাবাদ, মাছধরা ইত্যাদি ছাড়াও মানুষের সৃষ্টিরহস্য, বৃষ্টি কামনা ও দৈবশক্তির প্রভাব প্রত্যাশা করেও তারা নৃত্য করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন প্রবাদও প্রচলিত আছে যে, নাচ যত ভাল হবে ফসলও তত ভাল হবে। তাই তারা দেহমন উজাড় করে নৃত্য করে। ঢাক, ঢোল, বাঁশি ও মাদল উপজাতীয় নৃত্যের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।
ময়মনসিংহের গারোদের মধ্যে সমাজপতিকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ‘গান্না’ নামে এক উৎসবের প্রচলন আছে। তাতে নোক্মা বা সমাজপতিকে অঙ্গুরীয় পরানো হয়। তারপর নোক্মা তাঁর স্ত্রীসহ সকলের সঙ্গে অবস্থান করেন এবং তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এ নৃত্যে কোনো অভিনয় নেই, এমনকি পদচালনা বা দেহভঙ্গিও নেই। এ অঞ্চলে ‘জারিয়ালি’ নামেও একপ্রকার নাচের প্রচলন আছে। গারোদের মধ্যে গাছ থেকে ফল পাড়ার কৌশলকে এ নাচে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এমনকি পায়রা কেমন করে খাবার সংগ্রহ করে, কেমন করে পরস্পরকে খাওয়ায়, কেমন করে প্রেমময় মুহূর্তে পরস্পরকে আদর করে, তাও নৃত্যের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। মারমাদের থালানৃত্য ও মাছধরা নৃত্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ফসল বোনা, নবান্ন এসব তো আছেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের লুসাই আর কুকিদের মধ্যে নাচ ছাড়া কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই সম্ভব নয়। ফসল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে তারা যে নাচ পরিবেশন করে তার নাম ‘চাই’। এ নাচ জুমচাষের প্রথম পর্বে, ফসল পাকার পর এবং ফসল কাটার সময় এ তিন পর্যায়ে পরিবেশিত হয়। খুবই একঘেয়ে এর অঙ্গ ও পদসঞ্চালন। গ্রামপ্রধানের বাড়ির আঙ্গিনায় ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে সারারাত ধরে নাচে। এ নাচের শুরুতে মোরগ-মুরগি উৎসর্গ করা হয়।
মহামুনি মেলা চাকমাদের এক অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এ মেলাকে কেন্দ্র করেই বসন্তের আগমনে শুরু হয় নাচগানের পর্ব। মহামুনি বুদ্ধের মূর্তি মন্দিরে স্থাপনের মাধ্যমে এ পর্বের সূচনা হয়। এতে যুবক-যুবতীরা একত্রে অংশগ্রহণ করে। এ নাচে ভক্তিরসের প্রাধান্য থাকে। এ ছাড়াও চাকমাদের মধ্যে ভাল ফলনের আকাঙ্ক্ষা, বৃষ্টি আবাহন এবং শুধু চিত্তবিনোদনের জন্যও নাচ হয়। বৃষ্টি কামনায় যে নাচের আয়োজন করা হয় তাতে ছেলেমেয়েরা ছাড়া বৃদ্ধরাও অংশগ্রহণ করে এবং কলসভর্তি পানি ছেলেমেয়েদের গায়ে ছিটিয়ে নাচের আমেজকে চাঙ্গা করে তোলা হয়। চাকমাদের বাঁশনৃত্য সর্বাধিক প্রচলিত। এ নৃত্য দর্শক-হূদয়কে চমৎকৃত করে। দুটি লম্বা বাঁশের দুদিক দুজনে ধরে বাঁশে বাঁশে আঘাত করে ছন্দোময় শব্দমালা সৃষ্টি করে। নৃত্যশিল্পীরা তারই তালেতালে নেচে একবার দুই বাঁশের ভেতরে যায়, আবার বেরিয়ে আসে। এখানেই শিল্পীদের কৃতিত্ব। একে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘চেরালাম’ নৃত্য।
মুরং বা খুসী আদিবাসীদের কেউ মারা গেলে তারা শোক প্রকাশ করে না। তাদের ধারণা, যে মারা গেছে তার জন্য কাঁদলে তাকে কষ্ট দেওয়া হয়, তাই চির বিদায়কালে তাকে আনন্দদান করাই উচিত। এ কারণে তারা সাতদিন ধরে শবের চারপাশে নাচগান করতে থাকে, আর মৃতব্যক্তি কেমন ছিল, কি তার কীর্তি তা প্রকাশ করে। এ ছাড়া মৃতব্যক্তি জীবদ্দশায় যা কিছু ব্যবহার করত সে সবের প্রদর্শনী হয় শবদেহের পাশে, যেন সে স্বর্গে গিয়েও এসব ব্যবহার করতে পারে।
উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর ও দিনাজপুরে রাজবংশী সমাজে ‘হুদুমা’ নাচ প্রচলিত আছে। বৃষ্টির দেবতা বরুণকে তারা আঞ্চলিক ভাষায় বলে হুদুমা। চৈত্রমাসে অনাবৃষ্টি দেখা দিলে গ্রামের মেয়েরা অনাবাদি জমিতে বীজ আর লাঙ্গল নিয়ে উপস্থিত হয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে তারা দলবদ্ধভাবে গ্রাম্য মোড়লদের আঙ্গিনায় হাজির হলে বাড়ির অধিবাসী সকলে ঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। কারণ একটা কুসংস্কার আছে যে, এ দৃশ্য যদি কোনো পুরুষ দেখে ফেলে তাহলে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে, নতুবা আর কোনো দিন বৃষ্টি হবে না। এভাবে তাদের নাচ চলতে থাকে সারারাত এবং নাচতে নাচতে তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই ক্ষেতে ফিরে যায় এবং নিজ নিজ পরিধেয় পরে বাড়ি ফিরে আসে। এ নাচে অঙ্গভঙ্গিই প্রধান।
উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী এলাকায় ওরাওঁ আদিবাসীদের ‘করম’ উৎসব খুবই জনপ্রিয়। এটি তাদের ফসল উৎসব এবং অত্যন্ত সহজসরল ও আদিম ভাবধারায় উজ্জীবিত। কয়েক দিন ও রাত বিরতিহীনভাবে চলে এ করম নাচ। এরা ফসল বোনা ও ফসল কাটার ভঙ্গিতে নৃত্য পরিবেশন করে।
‘ঝুমুর’ নাচে দেবদেবীর বন্দনার রেওয়াজ আছে। কখনওবা প্রেম নিবেদন করে অথবা বৃষ্টি কামনায় এ নৃত্য পরিবেশিত হয়। এতে নানারকম অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে দারুণ উল্লাস প্রকাশের রীতি আছে। ‘জাতুর’ নাচ সাঁওতালদের সমাজজীবনের এক অভিনব বহিঃপ্রকাশ। ফসল কাটা, নবান্ন কিংবা বসন্তোৎসবে এ নাচের আয়োজন করা হয়। ছেলেমেয়েরা যৌথভাবে এ নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীরা দুটি বৃত্ত তৈরি করে। ভেতরের বৃত্তে থাকে মেয়েরা, আর বাইরের বৃত্তে ছেলেরা। এভাবে তারা দলবদ্ধভাবে নাচতে থাকে। ফসলের দেবতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথমে নৃত্য শুরু হয়। তারপর ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নাচতে নাচতে তারা দেবতার প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য নতজানু হয় এবং নমস্কারের ভঙ্গিতে আত্মনিবেদন করে। নাচের মাধ্যমে তারা কামনা করে তাদের এ আনন্দধারা যেন সারা বছর প্রবাহিত হয়। সেসঙ্গে আগামী বছরও যাতে ভাল ফসল পায় তার জন্যও দেবতার কাছে তারা প্রার্থনা করে। এ ছাড়া কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে তারা ‘জাতুর নাচ’ নেচে দেবতাকে তুষ্ট করে রোগের নিরাময় কামনা করে। নারী-পুরুষ সমন্বিত মুরং নৃত্য খুবই আকর্ষণীয়।
বিভিন্ন এলাকার উপজাতীয় নৃত্যের মধ্যে কমবেশি সাদৃশ্য রয়েছে। এ সাদৃশ্য দেখা যায় নাচের ধরন ও পরিবেশনায়। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়েও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ফসল কাটা, নবান্ন, জন্মমৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি নৃত্যানুষ্ঠানে প্রায়শই কোনো ভিন্নতা দৃষ্ট হয় না। জ্বরা-ব্যাধি দূর করা, দেবতাকে তুষ্ট করা, খরায় বৃষ্টি কামনা এসব উপজাতীয় নাচগানের সাধারণ বিষয়। তাদের নাচে বীররসের প্রাধান্য খুবই কম এবং বেশির ভাগ নাচই ধীরলয়ের ও একঘেয়ে।
উপজাতীয় নৃত্যে সাধারণত মঞ্চ দরকার হয় না; সাজসজ্জা, আলোকসম্পাত বা শব্দনিয়ন্ত্রণেরও কোনো প্রয়োজন নেই। সুরেবেসুরে সবাই মিলেই গান গায়। যন্ত্রের ব্যবহারও অনুরূপ। তবে এসব নৃত্য যখন মঞ্চে পরিবেশিত হয় তখন বিশুদ্ধ সঙ্গীত, আলোকসম্পাত, সাজসজ্জা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। টেলিভিশন প্রযুক্তির কারণে বর্তমানে উপজাতীয় নৃত্যের প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশে সমতল ও সীমান্তের পাহাড়ি অঞ্চলে আদি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় ও নেগ্রিটো নরগোষ্ঠীর বংশধর মণিপুরী, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুরং, চাকমা, গারো, খাসিয়া, কোচ, হাজং প্রভৃতি শ্রেণির উপজাতি বসবাস করে। তাদের কারও কারও জীবিকা, ধর্মবিশ্বাস ও জীবনধারায় রূপান্তর ঘটলেও আমূল পরিবর্তন হয় নি। বনজঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার ও জুমচাষ আজও তাদের প্রধান জীবিকা। তারা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের নানাক্ষেত্রে পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে আসছে।
প্রায় সবশ্রেণীর উপজাতিই পূজাপার্বণ, জন্মমৃত্যু, বিবাহ ও চিত্তবিনোদন উপলক্ষে নিজ নিজ পদ্ধতিতে নাচগানে মেতে ওঠে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে তারা কখনও একত্রে, কখনওবা এককভাবে নৃত্য করে; সঙ্গে থাকে নিজস্ব সঙ্গীতধারা। বাদ্যযন্ত্রগুলিও নিজেদের তৈরি। এ নৃত্য গোষ্ঠীভেদে সাঁওতাল নৃত্য, গারো নৃত্য, মণিপুরী নৃত্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। ঘরবাড়ি তৈরি, চাষাবাদ, মাছধরা ইত্যাদি ছাড়াও মানুষের সৃষ্টিরহস্য, বৃষ্টি কামনা ও দৈবশক্তির প্রভাব প্রত্যাশা করেও তারা নৃত্য করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন প্রবাদও প্রচলিত আছে যে, নাচ যত ভাল হবে ফসলও তত ভাল হবে। তাই তারা দেহমন উজাড় করে নৃত্য করে। ঢাক, ঢোল, বাঁশি ও মাদল উপজাতীয় নৃত্যের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।
গারো নৃত্য |
মারমাদের থালানৃত্য |
মহামুনি মেলা চাকমাদের এক অনন্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এ মেলাকে কেন্দ্র করেই বসন্তের আগমনে শুরু হয় নাচগানের পর্ব। মহামুনি বুদ্ধের মূর্তি মন্দিরে স্থাপনের মাধ্যমে এ পর্বের সূচনা হয়। এতে যুবক-যুবতীরা একত্রে অংশগ্রহণ করে। এ নাচে ভক্তিরসের প্রাধান্য থাকে। এ ছাড়াও চাকমাদের মধ্যে ভাল ফলনের আকাঙ্ক্ষা, বৃষ্টি আবাহন এবং শুধু চিত্তবিনোদনের জন্যও নাচ হয়। বৃষ্টি কামনায় যে নাচের আয়োজন করা হয় তাতে ছেলেমেয়েরা ছাড়া বৃদ্ধরাও অংশগ্রহণ করে এবং কলসভর্তি পানি ছেলেমেয়েদের গায়ে ছিটিয়ে নাচের আমেজকে চাঙ্গা করে তোলা হয়। চাকমাদের বাঁশনৃত্য সর্বাধিক প্রচলিত। এ নৃত্য দর্শক-হূদয়কে চমৎকৃত করে। দুটি লম্বা বাঁশের দুদিক দুজনে ধরে বাঁশে বাঁশে আঘাত করে ছন্দোময় শব্দমালা সৃষ্টি করে। নৃত্যশিল্পীরা তারই তালেতালে নেচে একবার দুই বাঁশের ভেতরে যায়, আবার বেরিয়ে আসে। এখানেই শিল্পীদের কৃতিত্ব। একে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘চেরালাম’ নৃত্য।
মুরং নৃত্য |
উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর ও দিনাজপুরে রাজবংশী সমাজে ‘হুদুমা’ নাচ প্রচলিত আছে। বৃষ্টির দেবতা বরুণকে তারা আঞ্চলিক ভাষায় বলে হুদুমা। চৈত্রমাসে অনাবৃষ্টি দেখা দিলে গ্রামের মেয়েরা অনাবাদি জমিতে বীজ আর লাঙ্গল নিয়ে উপস্থিত হয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে তারা দলবদ্ধভাবে গ্রাম্য মোড়লদের আঙ্গিনায় হাজির হলে বাড়ির অধিবাসী সকলে ঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। কারণ একটা কুসংস্কার আছে যে, এ দৃশ্য যদি কোনো পুরুষ দেখে ফেলে তাহলে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাবে, নতুবা আর কোনো দিন বৃষ্টি হবে না। এভাবে তাদের নাচ চলতে থাকে সারারাত এবং নাচতে নাচতে তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই ক্ষেতে ফিরে যায় এবং নিজ নিজ পরিধেয় পরে বাড়ি ফিরে আসে। এ নাচে অঙ্গভঙ্গিই প্রধান।
উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী এলাকায় ওরাওঁ আদিবাসীদের ‘করম’ উৎসব খুবই জনপ্রিয়। এটি তাদের ফসল উৎসব এবং অত্যন্ত সহজসরল ও আদিম ভাবধারায় উজ্জীবিত। কয়েক দিন ও রাত বিরতিহীনভাবে চলে এ করম নাচ। এরা ফসল বোনা ও ফসল কাটার ভঙ্গিতে নৃত্য পরিবেশন করে।
‘ঝুমুর’ নাচে দেবদেবীর বন্দনার রেওয়াজ আছে। কখনওবা প্রেম নিবেদন করে অথবা বৃষ্টি কামনায় এ নৃত্য পরিবেশিত হয়। এতে নানারকম অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে দারুণ উল্লাস প্রকাশের রীতি আছে। ‘জাতুর’ নাচ সাঁওতালদের সমাজজীবনের এক অভিনব বহিঃপ্রকাশ। ফসল কাটা, নবান্ন কিংবা বসন্তোৎসবে এ নাচের আয়োজন করা হয়। ছেলেমেয়েরা যৌথভাবে এ নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীরা দুটি বৃত্ত তৈরি করে। ভেতরের বৃত্তে থাকে মেয়েরা, আর বাইরের বৃত্তে ছেলেরা। এভাবে তারা দলবদ্ধভাবে নাচতে থাকে। ফসলের দেবতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথমে নৃত্য শুরু হয়। তারপর ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নাচতে নাচতে তারা দেবতার প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য নতজানু হয় এবং নমস্কারের ভঙ্গিতে আত্মনিবেদন করে। নাচের মাধ্যমে তারা কামনা করে তাদের এ আনন্দধারা যেন সারা বছর প্রবাহিত হয়। সেসঙ্গে আগামী বছরও যাতে ভাল ফসল পায় তার জন্যও দেবতার কাছে তারা প্রার্থনা করে। এ ছাড়া কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে তারা ‘জাতুর নাচ’ নেচে দেবতাকে তুষ্ট করে রোগের নিরাময় কামনা করে। নারী-পুরুষ সমন্বিত মুরং নৃত্য খুবই আকর্ষণীয়।
বিভিন্ন এলাকার উপজাতীয় নৃত্যের মধ্যে কমবেশি সাদৃশ্য রয়েছে। এ সাদৃশ্য দেখা যায় নাচের ধরন ও পরিবেশনায়। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়েও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ফসল কাটা, নবান্ন, জন্মমৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি নৃত্যানুষ্ঠানে প্রায়শই কোনো ভিন্নতা দৃষ্ট হয় না। জ্বরা-ব্যাধি দূর করা, দেবতাকে তুষ্ট করা, খরায় বৃষ্টি কামনা এসব উপজাতীয় নাচগানের সাধারণ বিষয়। তাদের নাচে বীররসের প্রাধান্য খুবই কম এবং বেশির ভাগ নাচই ধীরলয়ের ও একঘেয়ে।
উপজাতীয় নৃত্যে সাধারণত মঞ্চ দরকার হয় না; সাজসজ্জা, আলোকসম্পাত বা শব্দনিয়ন্ত্রণেরও কোনো প্রয়োজন নেই। সুরেবেসুরে সবাই মিলেই গান গায়। যন্ত্রের ব্যবহারও অনুরূপ। তবে এসব নৃত্য যখন মঞ্চে পরিবেশিত হয় তখন বিশুদ্ধ সঙ্গীত, আলোকসম্পাত, সাজসজ্জা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। টেলিভিশন প্রযুক্তির কারণে বর্তমানে উপজাতীয় নৃত্যের প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া