গারো বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি নৃগোষ্ঠী। টাংগাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর জেলায় এদের বাস। তবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় এরা অধিক সংখ্যায় বসবাস করে। এদের সংখ্যা প্রায় দেড়লক্ষ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যে এদের বসবাস রয়েছে। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে গারোরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর তিববতীবর্মণ শাখার বোড়ো উপশাখার অন্তর্ভুক্ত।
গারোদের আদি বাসভূমি বর্তমান চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশ, যেখান থেকে তারা দেশত্যাগ করে পরবর্তীকালে তিববতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় এরা বসবাস শুরু করে। প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে গারো পাহাড়ে তাদের বসবাস শুরু হয়। সর্বশেষ গারোরা ময়মনসিংহ জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
গারোদের সমাজ ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। মা-ই পরিবারের কর্তা ও সম্পত্তির অধিকারী এবং এক্ষেত্রে পিতা পরিবারের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করে। পরিবারের সন্তানসন্ততিরা মায়ের পদবি ধারণ করে। গারোদের প্রথাগত আইন অনুযায়ী পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মেয়েরা। তবে শুধুমাত্র নির্বাচিত মেয়েই সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করে। সেই নির্বাচিত মেয়েকে গারো ভাষায় নক্না বলে। সাধারণত পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সন্তানকেই নক্না নির্বাচন করা হয়। বর্তমানে মা-বাবা তাদের জীবিতাবস্থাতেই পুত্রসন্তানের নামে জমি লিখে দিচ্ছেন।
সমগ্র গারোসমাজ ১৩টি দলে বিভক্ত। এরা হলো: আওয়ে, আবেং, আত্তং, রূগা, চিবক, চিসক, দোয়াল, মাচ্চি, কচ্চু, আতিয়াগ্রা, মাৎজাংচি, গারা-গানচিং ও মেগাম। বাংলাদেশে আবেং, রূগা, আত্তং, মেগাম, চিবক প্রভৃতি দলভুক্ত গারোরাই বসবাস করে। এদেশে আবেং দলভুক্ত গারোদের সংখ্যাই বেশি। ১৩টি দল ছাড়াও সমগ্র গারো সমাজ ৫টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হচ্ছে: সাংমা, মারাক, মোমিন, শিরা ও আরেং। গারো সমাজে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণরূপে অসবর্ণ প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একই উপগোত্রের মধ্যে বিবাহ গারোসমাজে নিষিদ্ধ। গারোরা নিজেদের আচিক্ মান্দে (পাহাড়ের মানুষ) বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। গারো নামটি তাদের মতে অপরের চাপিয়ে দেওয়া এবং শ্লেষাত্মক বিধায় গারোদের কাছে আপত্তিকর ও অবমাননাকর।
গারোদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, ডাল ও শাকসবজি তারা আহার করে। শুঁটকি মাছ গারোদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য। দেশের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ভৈরব, কিশোরগঞ্জের ভাঁটি এলাকায় প্রাপ্ত পুঁটি মাছের হিদল শুঁটকি গারোদের নিকট প্রিয়। তরকারি রান্নায় গারোরা বেশি পরিমাণে কাঁচামরিচ ব্যবহার করে। গারোরা বিভিন্ন সবজি যেমন বেগুন, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিংগা, চিচিংগা, করলা, বরবটি, কচু প্রভৃতি খেতে ভালবাসে। ক্ষারজল ছাড়াও গারোরা বর্তমানে বাজার থেকে বিলাতি সোডা কিনে তরকারি রান্নার কাজে ব্যবহার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের গারোদের মাঝে খুব কম সংখ্যক পরিবারেই ক্ষারজল ব্যবহূত হয়ে থাকে। ইদানিং গারোদের রান্নার পদ্ধতি এবং রুচি বদলেছে। তারা নাখাম্ তরকারির পাশাপাশি ভর্তা, ভাজি, ডাল, মাছ, মাংস, নিরামিষ প্রভৃতি রান্নায় এবং আহারে প্রতিবেশী বাঙালিদের মতোই পটু হয়ে উঠেছে। এমনকি অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকজনেরা খিঁচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি আহারেও অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের রান্নার পদ্ধতিও বর্তমানে বাঙালিদের অনুরূপ। শূকরের মাংস, কচ্ছপ এবং কুঁচে তারা পছন্দ করে। বাঁশের কঁচি চারা এবং ব্যাঙের ছাতা গারোদের অন্যতম প্রিয় সবজি।
অতিথি আপ্যায়নে, নানা পালাপার্বণে ধেনো পচুঁই মদ গারোদের নিকট অপরিহার্য। প্রটেস্টটান্ট খ্রিস্টানদের মধ্যে মদপানের প্রচলন নেই বললেই চলে। তবে ক্যাথলিক গারোরা এ ব্যাপারে উদার। কৃষ্টির অঙ্গ হিসেবে এবং শারীরিক পরিশ্রমের পর ক্লান্তি দূর করার জন্যে গারোরা পঁচুই পান করে।
গারোদের পোশাকপরিচ্ছদ বাঙালিদের মতো। পুরুষেরা লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাজামা, ট্রাউজার, শার্ট এবং মেয়েরা শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, সালোয়ার কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করে। গারো মহিলাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিচ্ছদ রয়েছে এবং সেগুলো তারা অনেক সময় ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার করে। গারোরা এই পোশাককে দক্বান্দা বলে। দক্বান্দায় বিভিন্ন শিল্পকর্ম চিত্রিত থাকে। ব্রিটিশ শাসনকালে গারো পুরুষরা হাফপ্যান্ট এবং শার্ট ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। পরে গারো পুরুষেরা ধুতি শার্ট ব্যবহার শুরু করে। তারা বড় সাইজের রঙ্গীন গামছা ধুতির কায়দায় পিছনে মালকাছা করে পরিধান করে। সঙ্গে গেঞ্জি বা শার্ট ব্যবহার করে। বর্তমানে গারোরা লুঙ্গি ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। আগেকার দিনে গারো মহিলারা চাঁদিরূপার গহনাই বেশি ব্যবহার করতেন। বর্তমানে অবস্থাপন্ন পরিবারের মহিলারা সোনার গহনা ব্যবহার করে। খ্রিস্টান ধর্মমতে বিবাহের সময় বর-কনে উভয়েরই আংটি পরিধান এবং আংটি বিনিময় অবশ্য পালনীয়।
খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে গারোরা ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। উনিশ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারিগণ গারোদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করে। ধর্মপ্রচারের শুরুতে তাঁরা গুরুত্বারোপ করে শিক্ষার উপর। বর্তমানে গারো অধ্যুষিত প্রত্যেক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মিশনকেন্দ্রগুলিতে উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। গারোদের শিক্ষার হার প্রায় ৮০%।
বর্তমানে গারোদের শতকরা নিরানববইজনই খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। তবে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বে গারোদের আদিধর্মকে অনেকেই জড়োপাসনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গারোদের আদিধর্ম জড়োপাসনা ছিল না। কারণ গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করতো। আদি ধর্মে বিশ্বাসী গারোদের সমাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কিংবা সমাজে যারা খামাল্ অর্থাৎ পুরোহিত হিসেবে গণ্য তারাই কেবল দেবদেবীর অস্তিত্ব এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত। সমাজে খামাল্দের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই খামাল্রাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন, অসুখ-বিসুখের কারণ নির্ণয় করেন, কোন দেবতার কোপদৃষ্টিহেতু অসুখ হয়েছে তা ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞাত হন এবং প্রতিকার বিধান করেন। স্বপ্নযোগেই খামালদের দেবদেবীরা উপাসনামন্ত্র শেখায় এবং সেই মন্ত্র নির্দিষ্ট কোন একটি মন্ত্র নয়। প্রায় প্রতিটি দেবদেবীর উপাসনায় নানা ধরনের মন্ত্র রয়েছে। খামাল্ বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত হয়না। সমাজের যে কেউ নিজ যোগ্যতাবলে খামাল্ নিযুক্ত হতে পারে। তবে সাধারণত সদ্গুণাবলীর অধিকারী পূর্ণবয়স্ক পুরুষই দৈব প্রদত্ত ক্ষমতাবলে খামাল্ পদে আসীন হন।
উনিশ শতকের শেষে গারোদের মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারিগণ। তাঁরা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানাধীন বিরিশিরি গ্রামে অবস্থান করে গারোদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন এবং একাজে তাঁরা অচিরে সাফল্য অর্জন করেন। অপরদিকে খ্রিস্টানদের আরেক প্রধান সম্প্রদায় রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মিশনারিগণ ১৯০৯ সালের দিকে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার রাণীখং এলাকার গারোদের মধ্যে তাঁদের প্রচার কাজ শুরু করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের প্রচারকাজেও ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি তাঁরা গারোদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। খ্রিস্টান গারোরা প্রধানত দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত: প্রটেস্টান্ট (ব্যাপ্টিস্ট) এবং রোমান ক্যাথলিক। এই দুটি সম্প্রদায়ের অনুসারীদের মধ্যে বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রধান এ দুটি সম্প্রদায় ছাড়াও চার্চ অব বাংলাদেশ ও সেভেনডে এ্যাড্ভেন্টিস্ট নামে দুটি খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত গারোও এদেশে রয়েছে, তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
গারোদের আদি বাসভূমি বর্তমান চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশ, যেখান থেকে তারা দেশত্যাগ করে পরবর্তীকালে তিববতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় এরা বসবাস শুরু করে। প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে গারো পাহাড়ে তাদের বসবাস শুরু হয়। সর্বশেষ গারোরা ময়মনসিংহ জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
গারো নারী |
সমগ্র গারোসমাজ ১৩টি দলে বিভক্ত। এরা হলো: আওয়ে, আবেং, আত্তং, রূগা, চিবক, চিসক, দোয়াল, মাচ্চি, কচ্চু, আতিয়াগ্রা, মাৎজাংচি, গারা-গানচিং ও মেগাম। বাংলাদেশে আবেং, রূগা, আত্তং, মেগাম, চিবক প্রভৃতি দলভুক্ত গারোরাই বসবাস করে। এদেশে আবেং দলভুক্ত গারোদের সংখ্যাই বেশি। ১৩টি দল ছাড়াও সমগ্র গারো সমাজ ৫টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হচ্ছে: সাংমা, মারাক, মোমিন, শিরা ও আরেং। গারো সমাজে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণরূপে অসবর্ণ প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একই উপগোত্রের মধ্যে বিবাহ গারোসমাজে নিষিদ্ধ। গারোরা নিজেদের আচিক্ মান্দে (পাহাড়ের মানুষ) বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। গারো নামটি তাদের মতে অপরের চাপিয়ে দেওয়া এবং শ্লেষাত্মক বিধায় গারোদের কাছে আপত্তিকর ও অবমাননাকর।
গারোদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, ডাল ও শাকসবজি তারা আহার করে। শুঁটকি মাছ গারোদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য। দেশের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ভৈরব, কিশোরগঞ্জের ভাঁটি এলাকায় প্রাপ্ত পুঁটি মাছের হিদল শুঁটকি গারোদের নিকট প্রিয়। তরকারি রান্নায় গারোরা বেশি পরিমাণে কাঁচামরিচ ব্যবহার করে। গারোরা বিভিন্ন সবজি যেমন বেগুন, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিংগা, চিচিংগা, করলা, বরবটি, কচু প্রভৃতি খেতে ভালবাসে। ক্ষারজল ছাড়াও গারোরা বর্তমানে বাজার থেকে বিলাতি সোডা কিনে তরকারি রান্নার কাজে ব্যবহার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের গারোদের মাঝে খুব কম সংখ্যক পরিবারেই ক্ষারজল ব্যবহূত হয়ে থাকে। ইদানিং গারোদের রান্নার পদ্ধতি এবং রুচি বদলেছে। তারা নাখাম্ তরকারির পাশাপাশি ভর্তা, ভাজি, ডাল, মাছ, মাংস, নিরামিষ প্রভৃতি রান্নায় এবং আহারে প্রতিবেশী বাঙালিদের মতোই পটু হয়ে উঠেছে। এমনকি অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকজনেরা খিঁচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি আহারেও অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের রান্নার পদ্ধতিও বর্তমানে বাঙালিদের অনুরূপ। শূকরের মাংস, কচ্ছপ এবং কুঁচে তারা পছন্দ করে। বাঁশের কঁচি চারা এবং ব্যাঙের ছাতা গারোদের অন্যতম প্রিয় সবজি।
অতিথি আপ্যায়নে, নানা পালাপার্বণে ধেনো পচুঁই মদ গারোদের নিকট অপরিহার্য। প্রটেস্টটান্ট খ্রিস্টানদের মধ্যে মদপানের প্রচলন নেই বললেই চলে। তবে ক্যাথলিক গারোরা এ ব্যাপারে উদার। কৃষ্টির অঙ্গ হিসেবে এবং শারীরিক পরিশ্রমের পর ক্লান্তি দূর করার জন্যে গারোরা পঁচুই পান করে।
গারোদের পোশাকপরিচ্ছদ বাঙালিদের মতো। পুরুষেরা লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাজামা, ট্রাউজার, শার্ট এবং মেয়েরা শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, সালোয়ার কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করে। গারো মহিলাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিচ্ছদ রয়েছে এবং সেগুলো তারা অনেক সময় ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার করে। গারোরা এই পোশাককে দক্বান্দা বলে। দক্বান্দায় বিভিন্ন শিল্পকর্ম চিত্রিত থাকে। ব্রিটিশ শাসনকালে গারো পুরুষরা হাফপ্যান্ট এবং শার্ট ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। পরে গারো পুরুষেরা ধুতি শার্ট ব্যবহার শুরু করে। তারা বড় সাইজের রঙ্গীন গামছা ধুতির কায়দায় পিছনে মালকাছা করে পরিধান করে। সঙ্গে গেঞ্জি বা শার্ট ব্যবহার করে। বর্তমানে গারোরা লুঙ্গি ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। আগেকার দিনে গারো মহিলারা চাঁদিরূপার গহনাই বেশি ব্যবহার করতেন। বর্তমানে অবস্থাপন্ন পরিবারের মহিলারা সোনার গহনা ব্যবহার করে। খ্রিস্টান ধর্মমতে বিবাহের সময় বর-কনে উভয়েরই আংটি পরিধান এবং আংটি বিনিময় অবশ্য পালনীয়।
খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় শিক্ষাক্ষেত্রে গারোরা ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। উনিশ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারিগণ গারোদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করে। ধর্মপ্রচারের শুরুতে তাঁরা গুরুত্বারোপ করে শিক্ষার উপর। বর্তমানে গারো অধ্যুষিত প্রত্যেক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মিশনকেন্দ্রগুলিতে উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। গারোদের শিক্ষার হার প্রায় ৮০%।
বর্তমানে গারোদের শতকরা নিরানববইজনই খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। তবে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বে গারোদের আদিধর্মকে অনেকেই জড়োপাসনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গারোদের আদিধর্ম জড়োপাসনা ছিল না। কারণ গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করতো। আদি ধর্মে বিশ্বাসী গারোদের সমাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কিংবা সমাজে যারা খামাল্ অর্থাৎ পুরোহিত হিসেবে গণ্য তারাই কেবল দেবদেবীর অস্তিত্ব এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত। সমাজে খামাল্দের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই খামাল্রাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন, অসুখ-বিসুখের কারণ নির্ণয় করেন, কোন দেবতার কোপদৃষ্টিহেতু অসুখ হয়েছে তা ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞাত হন এবং প্রতিকার বিধান করেন। স্বপ্নযোগেই খামালদের দেবদেবীরা উপাসনামন্ত্র শেখায় এবং সেই মন্ত্র নির্দিষ্ট কোন একটি মন্ত্র নয়। প্রায় প্রতিটি দেবদেবীর উপাসনায় নানা ধরনের মন্ত্র রয়েছে। খামাল্ বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত হয়না। সমাজের যে কেউ নিজ যোগ্যতাবলে খামাল্ নিযুক্ত হতে পারে। তবে সাধারণত সদ্গুণাবলীর অধিকারী পূর্ণবয়স্ক পুরুষই দৈব প্রদত্ত ক্ষমতাবলে খামাল্ পদে আসীন হন।
উনিশ শতকের শেষে গারোদের মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারিগণ। তাঁরা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানাধীন বিরিশিরি গ্রামে অবস্থান করে গারোদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন এবং একাজে তাঁরা অচিরে সাফল্য অর্জন করেন। অপরদিকে খ্রিস্টানদের আরেক প্রধান সম্প্রদায় রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মিশনারিগণ ১৯০৯ সালের দিকে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার রাণীখং এলাকার গারোদের মধ্যে তাঁদের প্রচার কাজ শুরু করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের প্রচারকাজেও ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি তাঁরা গারোদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। খ্রিস্টান গারোরা প্রধানত দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত: প্রটেস্টান্ট (ব্যাপ্টিস্ট) এবং রোমান ক্যাথলিক। এই দুটি সম্প্রদায়ের অনুসারীদের মধ্যে বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রধান এ দুটি সম্প্রদায় ছাড়াও চার্চ অব বাংলাদেশ ও সেভেনডে এ্যাড্ভেন্টিস্ট নামে দুটি খ্রিস্টীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত গারোও এদেশে রয়েছে, তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া