দৌলতপুর (কুমিল্লা)
কাজী নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে প্রায় তিন মাস দৌলতপুরে তার বন্ধু আলী আকবরের বাড়িতে ছিলেন। এ বাড়িতে থাকাকালে কবি তার বন্ধুর বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের প্রেমে পড়েন। তখন কবি সৈয়দা খাতুনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন নার্গিস আক্তার খানম। এ বাড়িতেই ১৯২১ সালের ১৮ জুন নজরুল- নার্গিসের বিয়ে হয়। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। কবির বাসর ঘরে ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক ও নজরুল ব্যবহৃত কাঠের সিন্দুক এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। দৌলতপুরের সেই বাড়ির পাশেই রয়েছে কবির স্মৃতিবিজড়িত পুকুর ও পুকুর পাড়ের আমগাছ। আমগাছটির নিচে বসে কবি নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মরে গেছে। গাছের গোড়াটি স্মৃতি হিসেবে পাকা করে রাখা হয়েছে। নজরুল দৌলতপুরে অবস্থানকালে ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা লিখেছেন।
নজরুল ইন্সটিটিউট (ধানমণ্ডি, ঢাকা)
নজরুলের শেষ জীবনে সাক্ষী ধানমণ্ডির ৩৩০ বি নম্বরের বাড়ি ‘কবি ভবনে’ ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় নজরুল ইন্সটিটিউট। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত কবি নজরুল ইসলামের স্মৃতি রক্ষা, সাহিত্য-সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও কবির ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে তুলে ধরার জন্য গড়ে উঠেছে নজরুল ইন্সটিটিউট। ইন্সটিটিউটের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে নজরুল জাদুঘর। নজরুল ইন্সটিটিউটের দক্ষিণ- পূর্বদিকে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘরটির অবস্থান। কবি ভবনের যে ঘরে নজরুল ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর বাস করে গেছেন সে ঘরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল জাদুঘর। নজরুল জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে নজরুলের হস্তলিপির ফটোকপি, কাব্যগ্রন্থের দুর্লভ সংস্করণের ফটোকপি, কবির স্মৃতিবিজড়িত দুর্লভ আলোকচিত্র, গ্রামোফোন রেকর্ডার, গ্রামোফোন রেকর্ড অডিও ক্যাসেট, কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং পুস্তকের সংগ্রহ।
কাজীর শিমলায় দারোগা বাড়ি
ময়মনসিংহের ত্রিশাল মহাসড়ক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কাজী নজরুলের আরেক স্মৃতিবিজড়িত স্থান কাজীর শিমলা দারোগা বাড়ি। কাজীর শিমলা দারোগা বাড়িতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ দেশে প্রথম পদার্পণ ঘটেছিল। কিশোর নজরুলের সুকুমার চেহারা, নম্র স্বভাব ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে কাজী রফিজউল্লা দারোগা ১৯১৪ সালে আসানসোলের রুটির দোকান থেকে কিশোর কবি নজরুলকে কাজীর শিমলায় নিজ গ্রামে নিয়ে আসেন। দারোগা রফিজউল্লার বাড়িতে কবি নজরুল অনেক বছর ছিলেন। কবির কৈশোরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সে বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে দোতলাবিশিষ্ট নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও নজরুল পাঠাগার ভবন। এই নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে কবির গানের বই, কবিতা, কবির দুর্লভ আলোকচিত্র ও কাজী নজরুলের ব্যবহৃত খাট সংরক্ষিত আছে। নজরুল দারোগা বাড়ির পুকুরে আপন মনে সাঁতার কাটতেন। কবির সেই প্রিয় পুকুরটিতে বর্তমানে শান বাঁধানোর ঘাট বানানো হয়েছে।
কবির সমাধিসৌধ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই বিদ্রোহী কবি চিরশায়িত আছেন। মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই- এই কবিতায় তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার কথা বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধির এক পাশে রয়েছে মসজিদ, আর অন্য পাশে চারুকলা ইন্সটিটিউট। এরই ফাঁকে সুপারিগাছে ঘেরা ছোট্ট প্রাঙ্গণটিতে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন বিদ্রোহী কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নজরুলের কবরসংলগ্ন এলাকাটির সৌন্দর্যবৃদ্ধি করতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। নজরুলের কবরের সামনে তৈরি করা হয় একটি ছোট্ট গোলচত্বর। এই গোলচত্বরের শোভাবর্ধন করতে সেখানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লাইন পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ করে বসানো হয়েছে।
ত্রিশালে বিচুতিয়া বেপারি বাড়ি
ত্রিশালের নামাপাড়ার বিচুতিয়া বেপারি বাড়ির নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে কবির স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্রের নিচতলায় রয়েছে মিলনায়তন। দোতলায় সংরক্ষণ করা হয়েছে কবির স্মৃতিবিজড়িত দুর্লভ আলোকচিত্র- যুদ্ধ ফেরত কবির ছবি, তিন বন্ধু অধ্যাপক হেমন্ত সরদার, হাবিবুল্লা বাহার ও নজরুলের আলোকচিত্র, চুরুলিয়া যে গৃহে নজরুল জন্মগ্রহণ করেন তার আলোকচিত্র, নজরুলের কোলে শিশুপুত্র বুলবুল ও কবি পত্নী প্রমিলার আলোকচিত্র, বংশীবদনরত নজরুলের আলোকচিত্র, হাবিলদার বেশে নজরুল ও ২১ বছর বয়সে নজরুলের বিভিন্ন আলোকচিত্র। এছাড়া গ্রামোফোন, বৈদ্যুতিক এলপি রেকর্ডারসহ আরও অনেক কিছু এখানে আছে। বিচুতিয়ার এ বাড়িতেই কবি জায়গির ছিলেন। পুরো স্মৃতিকেন্দ্রটি গাছগাছালিতে ঘেরা। বিচুতিয়ার বেপারি বাড়ির পাশেই নামাপাড়ায় রয়েছে ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বটতলার স্কুল পালিয়ে নামাপাড়া যে বটগাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন সেই বটবৃক্ষটি এখনও রয়েছে। এখান থেকে দশ মিনিট এগুলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাল্য বিদ্যাপীঠ সাবেক দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়। নজরুল এ স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছেন।