মাকড়সাকে আমরা কম-বেশি অনেকেই চিনি। বনে-জঙ্গলে, ঘরের কোণে, দেয়ালে, অব্যবহৃত কামরায় মাকড়সা দেখতে পাওয়া যায়। মাকড়সা হচ্ছে অ্যারাচনিডা শ্রেণীর অ্যারানিয়ে বর্গের সদস্য। চার জোড়া পা এবং পেডিসেল বা বোঁটা দ্বারা যুক্ত শিরবক্ষ অবিভক্ত উদর নিয়ে গঠিত এ প্রাণীটি। মাকড়সার শিরবক্ষ একটি বর্মে ঢাকা থাকে এবং আটটি বা এর চেয়ে কম সংখ্যক একক চোখ আছে।
পেটের তলায় সামনের দিকে আছে রেশম গ্রন্থির সঙ্গে যুক্ত তিন জোড়া ক্ষুদে সুতা কাটার যন্ত্র। রেশম গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন প্রোটিনসমৃদ্ধ আঠাল তরল বাতাসের সংস্পর্শে শক্ত রেশম সুতায় পরিণত হয়। আজীবন রেশম সুতা তৈরির ক্ষমতা মাকড়সার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। জালবাসী মাকড়সারাই সর্বাধিক পরিমাণ রেশম সুতা উৎপাদন করে। শিকার ধরে সেটিকে মুড়ে রাখতে, ডিম ঢাকতে, বাসা বানাতে, সুড়ঙ্গগুলোতে আস্তরণ দিতে ইত্যাদি কাজে মাকড়সা এ সুতা ব্যবহার করে থাকে। কোন পতঙ্গ সুতার ওপর দিয়ে হাঁটলে তার সংকেত মাকড়সার কানে পৌঁছে যায়, আর তাৎক্ষণিকভাবে ওই পতঙ্গকে শিকারে পরিণত করতে ভুল করে না সে। কোন কোন মাকড়সা বনে কীটপতঙ্গ খোঁজার সময় সুতার সাহায্যে ঝুলে নিরাপদে ডাল বা পাতা টপকায়।
মাকড়সা মুক্তজীবী। সাধারণত এরা নিঃসঙ্গ শিকারি। এরা কীটপতঙ্গ জাতীয় ক্ষুদে প্রাণী ধরে, যার মধ্যে মানুষের ক্ষতিকর রোগ বহনকারী কীটপতঙ্গও থাকে। তবে বড় বড় মাকড়সা ছোট সাপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীদের জালের ফাঁদে ফেলে শিকার করে।
সাধারণত যে কোন প্রাণীই খাদ্য খাওয়ার পর পেটের ভেতরে এর হজম প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু মাকড়সার ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়াটি ব্যতিক্রম। কারণ, মাকড়সা শরীরের বাইরে খাদ্য হজম করে থাকে। ধৃত শিকারের শরীরে মাকড়সার পেটে থাকা জারকরস (যা খাদ্য পরিপাক বা হজমের কাজে ব্যবহৃত হয়) ঢুকিয়ে দেয়। শিকারের গায়ে জারকরস ঢুকিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণ পর শিকারের কোষকলা গলে যায় ও প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মাকড়সা ওই জারিত বা পরিপাক হওয়া খাদ্যবস্তুর কোষকলার পুরোটাই শুষে নেয় এবং তা দ্রুত শরীরে আত্তীভূত হয়।
অধিকাংশ মাকড়সার বিষগ্রন্থি থাকলেও এই বিষ সাধারণত মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। তবে ব্ল্যাক উইডো ও ব্রাউন রেক্লুজ মাকড়সা এর ব্যতিক্রম। ব্ল্যাক উইডো নামের মাকড়সার বিষ মানুষের øায়ুতন্ত্র অসাড় করে দেয়। ব্রাউন রেক্লুজ কাউকে দংশন করলে দংশিত স্থনে পচন ধরে।
আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে মাকড়সার। যেটি প্রায় অনেকেরই অজানা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্ত্রী মাকড়সা যৌনকর্মের পর তার পুরুষ সঙ্গীটিকে খেয়ে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান, ক্ষুধায় কাতর স্ত্রী মাকড়সা অন্য কোন খাবারে সংস্থান করতে না পারলে শেষ মুহূর্তে তার পুরুষ সঙ্গীকেই খেয়ে ফেলে। যদিও খাদ্য হিসেবে পুরুষ মাকড়সা মোটেই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যৌনকর্মের পর ৩৩ শতাংশ স্ত্রী মাকড়সাই এ কাজটি করে। গবেষকদের নেতৃত্বদানকারী বিজ্ঞানী ড. শন ওয়াইল্ডার বিবিসিকে বলেন, আমাদের গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, স্ত্রী মাকড়সার ডিম উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে লিপিড প্রয়োজন। পুরুষ মাকড়সার দেহে অল্প পরিমাণ লিপিড রয়েছে। যৌন সংসর্গের পর পুরুষ সঙ্গীকে হত্যা করে সে তার দেহের লিপিড এবং আমিষ শুষে নেয়। এতে আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, সুস্বাদু হলে অনেক প্রাণী তাদের সঙ্গীকে খেতে পারে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত, পুরুষ মাকড়সা খাবার হিসেবে মোটেই সুস্বাদু নয়। পরে আমরা বুঝলাম, অনাহারে কাতর হওয়াতেই স্ত্রী মাকড়সা তার পুরুষ সঙ্গীটিকে শিকার করে।
স্ত্রী মাকড়সা সাধারণত ১-২টি বড় আকারের থলে উৎপাদন করে, তাতে কয়েক হাজার ডিম পাড়ে। ছোট জাতের মাকড়সারা বড়দের আগেই বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং জীবনকালের সিংহভাগই প্রজননকর্মে কাটায়, তারা কয়েকটি থলে উৎপাদন করে ও তাতে থাকে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ডিম। আকার ছাড়া বৃদ্ধির সময় মাকড়সার আর বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে না। জীবনকাল সম্ভবত বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই ১ মাস থেকে ১ বছর। ট্যারেন্টুলা মাকড়সা স্বাভাবিক অবস্থায় কত বছর বেঁচে থাকে তা জানা না গেলেও বন্দি অবস্থায় ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। স্ত্রী মাকড়সারা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী।
বোলতা হল মাকড়সার প্রধান শত্র“ এবং তারা মাকড়সা ও তাদের ডিমের পরজীবী। কোন কোন জাতের বোলতা তাদের লার্ভার খাদ্য হিসেবে বাসায় মাকড়সা জমা করে রাখে, অন্যরা ডিম পাড়ে মাকড়সার ডিমের থলেতে। অনেক মাকড়সাই নিরাপত্তার তাগিদে ডিমের থলেগুলো পাহারা দেয়।
মাকড়সা আদিম প্রাণীবর্গের অন্তর্ভুক্ত। এদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে ডিভোনিয়ান যুগের লাল শিলা স্তরে। ইউরোপ ও আমেরিকার কার্বনিফেরাস যুগের শিলা থেকেও এদের অনেক প্রজাতি সংগৃহিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত জানা ৩৭,২৯৬ প্রজাতির মাকড়সা ৩,৪৫০ গণ ও ১০৬ গোত্রে শ্রেণীবদ্ধ। প্রতি বছরই নতুন নতুন প্রজাতির মাকড়সা নিয়ে বর্র্ণনা হচ্ছে। সামনে হয়তো মাকড়সাকে নিয়ে আরও নতুন কোন বৈশিষ্ট্য বা তথ্য নিয়ে হাজির হবে বিজ্ঞান।