পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র নিয়ে রয়েছে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সব বিতর্কের আগুনে পানি ঢেলে দিয়েছে উটপাখির একটি ডিম। শুনতে অবাক লাগলেও বিষয়টা সত্যি। উটপাখির এ ডিমটা একেবারে সাদামাটা নয়। এর মধ্যে আঁকা রয়েছে পৃথিবীর মানচিত্র। গবেষকরা ধরেই নিয়েছেন, এটাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র। এটি মানচিত্র আবার একটি ভূ-গোলকও। একজন অস্ট্রিয়ান সংগ্রাহক এটি খুঁজে পেয়েছেন। আর মানচিত্রটি তৈরি হয়েছিল ১৫০৪ সালে। মানচিত্রে পৃথিবীর নতুন নতুন আবিষ্কৃত অঞ্চলসহ বিভিন্ন দেশ ও এলাকার উল্লেখ ছিল।
দুই টুকরো উটপাখির ডিমের খোলস জোড়া লাগিয়ে তবেই বানানো হয়েছে ভূ-গোলকটি। ল্যাটিন অক্ষরে এতে জাপান, আরব বা মধ্যপ্রাচ্য ও ব্রাজিলের বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। উত্তর আমেরিকাকে দেখানো হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু দ্বীপের সমষ্টি হিসেবে। দক্ষিণ আমেরিকার মাত্র তিনটি স্থানকে দেখানো হয়েছে ভূ-গোলকটিতে। এগুলো হল Mundus
Novus বা নতুন বিশ্ব, Tera
de Brayil এবং Terra
Sanctae Crucis বা পবিত্র ক্রুশের ভূমি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এলাকাগুলোর উপর Hic
Sunt Dracones নামে একটি বাক্য লেখা আছে। এর অর্থ হচ্ছে, এখানে ড্রাগন আছে। ওয়াশিংটন ম্যাপ সোসাইটির জার্নাল ‘পোর্টোলান’-এর সম্পাদক থমাস স্যান্ডার বলেন, ‘এরকম অনেক কৌতূহল জাগানো বিষয় রয়েছে ভূ-গোলকটিতে। প্রাচীন এই ভূ-গোলকটিতে সাগরদানব বা সি-মনস্টারের ছবিও আছে। এসব ছবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে সাগরের ওই এলাকাগুলো বিপজ্জনক। ভূ-গোলকটি নিয়ে গবেষণা করছেন স্টেফান মিসিন। তার ধারণা, সাগরদানবের ছবি দিয়ে আসলে সমুদ্রের ওই সব বিপজ্জনক স্থানগুলোকে নির্দেশ করা হত যেখানে বিশাল বিশাল বাণিজ্যিক ও যাত্রীবাহী জাহাজ প্রায়ই ডুবে যেত। ভূ-গোলকের অনেক জায়গায় ডুবন্ত জাহাজে নাবিকদের ছবিও আঁকা আছে।
যে ডিমের উপর মানচিত্র আঁকা হয়েছে সেটি পুরোপুরি গোল নয়। এছাড়া ভূ-গোলকের ঠিক মাঝ বরাবর, যেখানে দুটি ডিমকে জোড়া লাগানো হয়েছে সে জায়গাটিও বেশ কর্দমাক্ত। অনেক পুরনো হওয়ার কারণে ডিমটাও খানিকটা কুঁচকে গেছে। ডিমের খোলসও পাতলা হয়ে গেছে। স্টেফান আরো জানান, ডিমটির দুটো ভাগে আলাদা আলাদাভাবে মানচিত্র আঁকা হয়েছে। তারপর দুটো ভাগকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে।
মিসিনের ধারণা, ভূ-গোলকটি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওয়ার্কশপ থেকে কোনোভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। ভূ-গোলকের উপর প্রস্তুতকারীর নাম নেই। স্যান্ডারের ধারণা, ভিঞ্চির সময়কারই কেউ সাগর ঘুরে আসা নাবিকদের কাছ থেকে দেশ-দেশান্তরের ব্যাপারে ধারণা নিয়ে ইতালির কোনো অভিজাত ব্যক্তিকে উপহার দেয়ার জন্যই ভূ-গোলকটি বানিয়ে নিয়েছিলেন। তখনকার অভিজাত ব্যক্তিরা নিজের বাড়ির বাগানে উটপাখি লালন-পালন করতেন। বিষয়টা ছিল তাদের জন্য যেমন সম্মানের তেমনি গর্বের।
এরপর ভূ-গোলকটি হস্তান্তর হতে থাকে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে। অবশেষে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় চরম অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের সাথে এটিও বিক্রি হয়ে যায়।
২০১২ সালে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি লন্ডনের এক মানচিত্র মেলা থেকে ভূ-গোলকটি কেনেন। এরপর এটি মিসিনের হাতে আসে। তবে মিসিন কিভাবে কোথায় এটি পেয়েছেন সেই বিষয়ে মুখ খোলেননি।
অনেকে বলছেন, এই ভূ-গোলকটি মিসিনের কাছেই ছিল। অনেকে আবার এটিকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওয়ার্কশপের সাথে সম্পর্কহীন বলে দাবি করেছেন। ভূ-গোলকটি মিসিনের হোক আর যারই হোক- প্রাচীন দুনিয়ার অজানা কিছু তো জানা গেছে। সেটাই বা কম কী! আরো অনেক কিছু যে জানা যাবে না, সেটাই বা কে বলতে পারে?