প্রত্নতত্ত্বের শহর নওগাঁ --- ভ্রমণপিপাসুদের এক ঐতিহাসিক স্থান

ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। এর আদি নাম সোমপুর বিহার। ইতিহাসবিদদের মতে, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল আনুমানিক অষ্টম শতকের শেষের দিকে এ বিহার নির্মাণ করেছিলেন। পাহাড়পুর বিহার ইউনেস্কো ঘোষিত ৩২২তম বিশ্ব ঐতিহ্য। ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ বিহারের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট ও পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট বিস্তৃত। এ বিহারে মোট ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলোতে সে সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন। বিহারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মন্দির। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৪শ’ ফুট, প্রস্থে প্রায় ৩৫০ ফুট ও উচ্চতায় ৭০ ফুট। কালের বিবর্তনে মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধসে গেছে। বাইরের দেয়ালে বৌদ্ধমূর্তি, হিন্দুদের দেবী মূর্তি ও প্রচুর পোড়ামাটির ফলকচিত্র রয়েছে। এসব চিত্রে সাধারণ মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা চিত্রিত হয়েছে।

কুসুম্বা মসজিদ
নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামে ‘কুসুম্বা মসজিদ’ অবস্থিত। দেশের উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ। এর আরেক নাম কালো পাহাড়। মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের ওপর স্থাপিত আরবি শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি তথা ১৫৫৮-৫৯ সালে নির্মিত। শেরশাহ শুরির শাসনামলের শেষদিকে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে জনৈক সুলাইমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। ইটের তৈরি এ মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়াল পাথরের আস্তরণ দিয়ে আবৃত। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দুটি মিহরাব। বর্তমান পাঁচ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি রয়েছে।

পতিসরে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি
নওগাঁ জেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে জমিদার রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি। এখানেই রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। কবির স্মৃতিবিজড়িত এ কুঠিবাড়ি ঘিরে তৈরি করা হয়েছে একটি জাদুঘর। কুঠিবাড়ি ঢুকতেই প্রথমে চোখ পড়বে উঠানের ঠিক মাঝখানে কবিগুরুর ভাস্কর্য। এ কুঠিবাড়ির জাদুঘরে কবির ব্যবহৃত একটি পালঙ্ক, লোহার সিন্দুক, কলের লাঙল, দেয়াল আয়না, বাথটাব, আলমারি ও পড়ার টেবিল প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। রবিঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের ও শবযাত্রার বেশকিছু দুর্লভ ছবিও এখানে রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে কবির সহধর্মিণী, মহাত্মাগান্ধী, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, একেএম ফজলুল হকের সঙ্গে রবিঠাকুরের ছবি রয়েছে। কবি এখানে বসে লিখেছেন বহু গান ও কবিতা। নওগাঁ শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পতিসর রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি।

জয়স্তম্ভ
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার দিবরদীঘির মধ্যস্থানে অবস্থিত দিব্যকে জয়স্তম্ভ। এ দীঘি স্থানীয় জনগণের কাছে কর্মকারের জলাশয় নামে পরিচিত। বর্তমানে দীঘিটি ২০ একর জমির ওপর অবস্থিত। দিবরদীঘির মধ্যস্থানে অবস্থিত অষ্টকোণ বিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের একটি বিশাল স্তম্ভ যা বাংলাদেশে বিরল। এ স্তম্ভের সর্বমোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। স্তম্ভের কোনো লিপি না থাকলেও উপরিভাগ খাজকাটা অলংকরণ দ্বারা সুশোভিত। পাল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় মহিপালকে পরাজিত করার সাফল্যকে স্মরণীয় করার উদ্দেশে রাজা দিব্যক এটি নির্মাণ করেন। সে সময় এ জয়স্তম্ভের মাথায় বহু কোণবিশিষ্ট একটি রেডিয়াম পাথর স্থাপন করা ছিল, যা থেকে কৃষ্ণপক্ষের রজনীতে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বর্ণিল আলো বিচ্ছুরিত হত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মূল্যবান এ পাথরটি খোয়া গেলেও ওই নান্দনিক চির ভাস্কর দিব্যক জয়স্তম্ভটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

পাহাড়পুর জাদুঘর
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ সালে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের পাশেই একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়। পাহাড়পুর খননের সময় প্রাপ্ত নানা নিদর্শন নিয়ে সাজানো হয় পাহাড়পুর জাদুঘর। এ জাদুঘরে নবম শতকের কালো বেলে পাথরের মূর্তিগুলোর মধ্যে নাগা, চন্দ্রদেব, বলরাম, কীর্তিমুখ তারা এবং মহিষমদির্নী রয়েছে। এ ছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের নৃসিংহ তারা, পার্বতী, চন্দ্রদেবের মূর্তি, খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলের রূপার মুদ্রাসহ বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা, কয়েক হাজার পোড়ামাটির ফলকচিত্র, তাম্রলিপি, শিলালিপি, বাটখাড়া, শিলনোড়া ইত্যাদি এখানে স্থান পেয়েছে। জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রোববার পূর্ণদিবস এবং সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে। জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা।

যাওয়া ও থাকা
ঢাকা থেকে নওগাঁর দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার। সড়ক ও রেলপথে দু’ভাবেই নওগাঁ যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে শ্যামলী, হানিফ, কেয়া, এসআরটিআর ইত্যাদি পরিবহনের বাস নওগাঁর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। রেলপথে আপনি কমলাপুর স্টেশন থেকে দ্রুত যান, লালমনি এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস আর ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে আপনি নীল সাগর এক্সপ্রেসে নওগাঁ আসতে পারেন। ট্রেনের ভাড়া সাধারণ সিট ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। নওগাঁ শহরে থাকার জন্য হোটেল অবকাশ, হোটেল যমুনা, হোটেল সিয়ামসহ কিছু সাধারণ মানের হোটেল আছে।