বিশ্ব সভ্যতা ও ইতিহাসে মিশরীয়দের অবদান এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মিশরের পিরামিড ও মমি বিশ্ব ইতিহাসের এক অনবদ্য অধ্যায়। পিরামিডগুলো সাধারণত গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ফারাওদের সমাধিসৌধ হিসেবে। ফারাওদের মৃতদেহগুলো সরাসরি মাটি চাপা না দিয়ে মমি তৈরি করে পিরামিড বা সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হত। এই সমাধিসৌধ বা পিরামিডে মৃতদেহগুলোকে সমাহিত করার আগে মমি তৈরি করা হত। আবার এমন অনেক মৃতদেহ ছিল যেগুলোর জন্য পিরামিড তৈরি করা হত না তবে মৃতদেহগুলো মমি তৈরি করার পর সমাহিত করা হত। মমি তৈরি করার পিছনে ছিল এক অভিনব পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মমিগুলো এমনভাবে সংরক্ষণ করা হত যাতে সেগুলো পচে-গলে নষ্ট না হয়ে যায়।
মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরও মানুষের জীবনের অস্তিত্ব থাকে। আর সেজন্য তারা মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়-স্বজনের দেহ আগুনে দাহ করত না বা স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কবরস্থ করত না। যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে তারা ভূগর্ভস্থ কক্ষে শায়িত অবস্থায় বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে মৃতদেহগুলো কবরস্থ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মরুভূমির বুকেই তারা মমি তৈরির মাধ্যমে মৃতদেহ কবরস্থ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ করত। এই কবর দেওয়ার মাঝে ধনী, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাধারণের মাঝে পার্থক্যথাকত। ধনী বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কবরের উপর পাথর গেঁথে গেঁথে পিরামিড তৈরি করে স্মৃতি রক্ষা করা হত। মৃতদেহ সাধারণত কিছু দিন পর থেকে পচা-গলা শুরু হয় সেজন্য এগুলো অবিকৃত অবস্থায় পিরামিডে বা সমাধিতে সংরক্ষণ করা ছিল তাদের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। মৃতদেহগুলো পিরামিডে বা সমাধিতে অবিকৃত রাখতে মিশরীয়রা এক বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করত। যাকে বলা হয় মমি সংরক্ষণ পদ্ধতি। প্রথম দিকে তারা যে পদ্ধতিতে মমি সংরক্ষণ করত তাতে মৃতদেহ খুব বেশি দিন স্থায়ী হত না। মমি তৈরির পদ্ধতিতে ত্র“টি থাকার কারণে কিছু দিন পর নষ্ট হয়ে যেত। এর ফলে মিশরীয়রা চেষ্টা চালিয়েছিল নতুন কোনো পদ্ধতির আশ্রয় নিতে। সেই হিসেবে তারা তাদের পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মৃতদেহ দীর্ঘদিন অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত রাখার নতুন এক পদ্ধতির সূচনা করে। নতুন পদ্ধতি হিসেবে তারা মানুষের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ থেকে পচন ধরার আশংকা থাকে এরকম কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বের করে আলাদা করে রাখত। সেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে ছিল পাকস্থলী, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, যকৃত প্রভৃতি। এরপর তারা কেটে নেয়া দেহের অংশগুলো চারটি বিশেষ পাত্রে রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ডুবিয়ে রাখত। কয়েক ঘণ্টা পরে সেগুলো আবার মৃতদেহে প্রতিস্থাপন করত। এরপর মৃতদেহে লবণ মাখিয়ে প্রখর রোদে রাখা হত শুকানোর জন্য। এভাবে কয়েকদিন রোদে শুকানোর পর খুব সতর্কতার সাথে এমনভাবে মৃতদেহের পেটের কাটা অংশ সেলাই করা হত যাতে পেটের ভিতর কোনও প্রকার বাতাস না ঢুকতে না পারে। এরপর এক গামলা পাইন গাছের আঠা মৃতদেহের গায়ে ঘষেমেজে ভালো করে লেপে দেয়া হত। তারপর লিনেন কাপড়ের চওড়া ফিতে জড়িয়ে মৃতদেহটিকে বেশ পুরু করে ফেলা হত। লিনেন কাপড় বায়ু নিরোধক। ফলে সহজে এটি ভেদ করে বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। আপাদমস্তক কাপড় জড়ানোর পর একটি ঢাকনা যুক্ত কাঠের বাক্সে লিনেন কাপড়ে ঢেকে মমিটিকে রাখা হত। এরপর তারা শুরু করত সমাহিত করার কাজ।
সাধারণত বর্তমান সময়ের কবরের চেয়ে তাদের কবরের আয়তন অনেক বেশি বড় করা হত। কারণ কবরে কাঠের বাক্সসহ মৃতদেহ সমাহিত করা হত। মৃতদেহ বাক্সসহ কবরে শায়িত করার পর তার উপর মৃতব্যক্তির জীবিতকালে যেসব জিনিস প্রিয় ছিল সেসব কবরে দিয়ে দেয়া হত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল মৃতব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধারণ করে সারা দিন মনের সুখে এখানে ওখানে উড়ে বেড়ায়। দিনের শেষে আত্মা আবার নিথর দেহে ফিরে আসে। তাই তাদের জন্য থালা, বাটি থেকে শুরু করে আসবাবপত্রাদিও দরকার। এরকম ধারণার জন্য তারা জীবিত মানুষের কাছে যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় সবই কবরের মধ্যে মৃতব্যক্তির জন্য দিয়ে দিত। ধনী ব্যক্তিদের কবরে সাধ্যমতো সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হত।
সবচেয়ে বড় সমাধিসৌধগুলো ছিল পিরামিড। পিরামিডের জন্য মৃতদেহটিকে কবর দেয়ার পর তার চারিধার দিয়ে পাথর গেঁথে গেঁথে বিশাল উঁচু সমাধি তৈরি করা হত। আবার কিছু কিছু মৃতদেহ সযত্নে পিরামিডের অভ্যন্তরে স্থাপন করে রাখা হত। পিরামিডগুলো তারা তাদের নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি করত। আজকের মিশরের পিরামিডগুলো সেই সময় তৈরি হয়েছিল সমাধিসৌধ হিসেবে। যা এখন বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য বিষয়।