মগ পাহাড়ি এলাকায় মারমা এবং সমতল এলাকার রাখাইনদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উপজাতি। মারমা সম্প্রদায়ের অনেকের মতে মগ কোন স্বতন্ত্র উপজাতি নয়, আরাকানবাসীর একটি উচ্ছৃঙ্খল দল মাত্র। জাতিগতভাবে মগরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত; সাংস্কৃতিকভাবে তারা মায়ানমার (পূর্বের বার্মা) এলাকার জনসাধারণের কাছাকাছি। মগদের প্রধান (রাজা) দু’জন: বোমাং এবং মং। বোমাং রাজা বান্দরবানে, পক্ষান্তরে মং রাজা থাকেন খাগড়াছড়িতে। আরাকানি গোত্রের মধ্যে মগর অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ গোষ্ঠী। আরাকানিদের শাসনামলে (১৪৫৯-১৬৬৬) বাংলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কিছু মগ বসতি গড়ে উঠে থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে এর রেকর্ড পাওয়া যায় না।
১৭৮৪ সালে বার্মা কর্তৃক স্বাধীন আরাকান রাজ্যের পতনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মগদের প্রধান বসতি গড়ে ওঠে। বার্মার সাথে আরাকানের সংযক্তির পর বার্মার রাজা বোদাওপা (১৭৮২-১৮১৯) এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এর ফলে আরাকানের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে দেশান্তরিত হয়। ব্রিটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বার্মায় এক সাবেক নৌ অফিসার ক্যাপ্টেন এই কক্সকে মগ বসতির জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। তাঁর নামানুসারে বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়। সগদের এরূপ আশ্রয় দান ও তাদের লুটতরাজের ফলে ১৯২৪-২৫ সালে প্রথম ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে বার্মা পরাজিত হয় এবং ১৮২৬ সালের ইয়ানদাবু চুক্তির ফলে আরাকান ও তেনাসারিম অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনভুক্ত হয়।
এর ফলস্বরূপ, আরাকান থেকে দ্বিতীয় দফায় মগদের দেশত্যাগ আরম্ভ হয়, আরাকন থেকে আগত শরণার্থীরা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে একটা স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নেয়। ত্রমে মাতামুহুরী উপত্যকার মধ্য দিয়ে তারা বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়ে। মগরা এই এলাকাকে বোমাং থউং, বা বোমাং রাজার আবাসস্থল বলে অভিহিত করে। তৃতীয় দলটি সীতাকুণ্ড অঞ্চল থেকে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করে এবং রামগড়ে তাদের স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। তারা নিজেদের প্লং থা ও তাদের আবাসস্থলকে প্লং থং বলে দাবি করে। চতুর্থ দলটি বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে বৃহত্তর পটুয়াখালীর (বর্তমানে পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলা) দক্ষিণ অঞ্চলে পৌঁছে এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলে। রাঙ্গাবালি, বড় বাইজদিয়া ও আইলা প্রধান প্রধান মগবসতি ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা অঞ্চলটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মগরা এই এলাকাকে আওয়াজনওয়ে, অর্থাৎ সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ বলে অভিহিত করে।
বিশেষ করে বান্দরবান ও পটুয়াখালী জেলায় বিগত বছরসমূহে মগ জনসংখ্যা সার্বিকভাবে হ্রাস পায়। ১৯৭৪-১৯৯৭ মেয়অদকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের অসন্তোষ চলাকালে কিছু মগ কতিপয় অন্যান্য উপজাতির সাথে বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চল (যথা বান্দরবান জেলা) থেকে আরাকানে অভিবাসিত হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং মগদের দেশত্যাগ প্রক্রিয়া যথেষ্ট মন্থর হয়েছে। তবে পটুয়াখালীতে ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে কিছু কিছু মগ গ্রাম বিরান হয়ে গেছে। স্থানীয় নানা কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সামাজিক অসন্তোষের কারণে কিছু মগ এখনও দেশান্তরিত হচ্ছে।
মগদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, বর্মি ভাষার সাথে এর বেশ মিল আছে। মগদের সংখ্যা, দিন ও মাসের নাম বর্মি ভাষার মতোই। সাধারণভাবে মগদের নিজস্ব তেমন কোন সমৃদ্ধ সাহিত্য নেই। ধাঁধা, বাগধারা ও লোককাহিনী মগ সমাজে বেশ পরিচিত। ফঙ্গেই (ধর্মযাজক) এবং রোয়া (গ্রামীণ) স্কুল মগ সমাজে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে যৌথভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় মগ এ রাকায় ফঙ্গেই এবং রোয়াদের উপস্থিতির কারণে সাক্ষরতার হার বেশি। মগ সমাজের প্রত্যেক সদস্য বর্মি ভাষা অনর্গল পড়তে ও বলতে পারে। তবে কমিউনিটির নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা খুবিই অপ্রতুল। সে কারণে অনেক মগ ছেলে-মেয়েকে এলকার ভিতরে ও বাইরে সাধারণ স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করতে দেখা যায়।
মগদের প্রধান পেশা কৃষি। পাহাড়ি এলকায় তারা জুমচাষ করে এবং সমতল এলাকায় লাঙল দিয়ে চাষাবাদ করে। তাঁত বুনে এবং মাছ ধরেও অনেকের জীবিকা চলে। তাদের সমাজে ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং চাকরিজীবির সন্ধান কদাচিৎ পাওয়া যায়। শিশুশ্রম তাদের মধ্যে অজানা, কিন্তু মগ নারীদের মাঠে ও বিভিন্ন স্থাপণা নির্মাণস্থলে কাজ কতে দেখা যায়।
মগদের সমাজকাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের সর্বেসর্বা হচ্ছে জ্যেষ্ঠতম পুরুষ সদস্য। তথাপি মগ সমাজে নারীর একটা সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে। স্বামীর আবাসে স্ত্রীর অবস্থান প্রথাগত রীতি হলেও স্ত্রীর বাড়িতে স্বামীর অবস্থানের ঘটনাও একেবারে নির্লক্ষ্য নয়। একজন মগ নারী বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ িএবং সম্পত্তির ওপর মালিকানার ক্ষেত্রে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। অসবর্ণ এবং অন্তঃবর্ণ এই দু’ধরনের বিয়েই মগ সমাজে প্রচলিত আছে। বিধবা বিয়েও মেনে নেওয়া হয়। মগ সমাজ মারোথা, রাগ্রাথা, রামরায়্যাথা ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত। মগদের ভিক্ষু ধনপতিদের মৃতদেহ বেশ জাঁকজমকের সাথে দাহ করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মৃতদেহ মাটিতে দাফন করা হয়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধগণের মতোই মগরাও থেরবাদ (হীনযান) শ্রেণীর বৌদ্ধ। পালি ভাষায় লিখিত ত্রিপিটক হচ্ছে মগদের পবিত্র গ্রন্থ। ধর্মীয় বিষয়াবলির ক্ষেত্রে তারা দু’দলে বিভক্ত; সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং অপেশাদার সম্প্রদায় বা লেইতি। ভিক্ষুগণ কৌমার্যব্রত পালন করে, গেরুয়া রঙের ঢিলেঢালা বস্ত্র পরিধান করে এবং সন্ন্যাস আশ্রমে বাস করে। পক্ষান্তরে লেইতিগণ স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পারিবারিক জীবনযাপন করে।
মগদের অধিকাংশ উৎসবই প্রতি মাসের পূর্ণিমার সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাকে তারা বর্মি শব্দে লবরয় বলে। তাদের কাছে পূর্ণমা পবিত্র। তারা মনে করে, অধিকাংশ ধর্মীয় ঘটনাবলি মাসের কোন না কোন পূর্ণিমা রাত বা দিনে ঘটেছে। এ উপলক্ষে খাদ্র-দ্রব্য, ফল-মূল, ফুল এবং মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে প্রভু বুদ্ধের মূর্তি পূজা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণিমাসমূহরে মধ্যে রয়েছে বাসন (বৈশাখ), ওয়াসো (আষাঢ়), থাড়িংয়ুত (আশ্বিন) এবং বাবোড়ুই (মাঘী)। তারা ছাত্রদের দান-দক্ষিণা দেয়, সিলা (আচরণবিধি) ও ভাবনা (ধ্যানসাধানা) পালন করে। এ সকল বৌদ্ধধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি তারা প্রাকৃত পূজার প্রথানুযায়ী গাছপালা এবং বড় বড় নদীর উপাসনা করে।
মগদের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হচ্ছে পানি উৎসব। জাতপোয়ে নামক পালা ও ইয়েনপোয়ে নামক নৃত্য হচ্ছে জনপ্রিয় বিনোদন। পালাটি বৌদ্ধদের জ্ঞান ও প্রাচীন বৌদ্ধ রাজাদের জীবনগাথার সাথে যুক্ত, পকষান্তরে উক্ত নৃত্যটি পশ্চাত্য বল নৃত্যের সমপর্যায়ভুক্ত। লোকসংখ্যা হ্রাসের সাথে সাথে এ সকল উৎসব উৎদাপন কমে গেছে। মগদের সঙ্গীত যন্ত্রসমূহের মধ্যে সেইং ওয়েইং (বৃত্তাকার বড় আকৃতির কাঠের ঢোল), কিয়ে ওয়েইং (ছোট আকৃতির কাঠের ঢোল), পিলিঈ (বাঁশি) এবং ঝিনে গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল যন্ত্রের সাথে বার্মায় ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের মিল রয়েছে।
ভাত, সবজি ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণ মরিচ ও লবণ হচ্ছে মগদের প্রধান খাদ্য। তারা দিনে দু’বেলা আহার গ্রহণ করে। নাপ্পি (বাসি মাছ) ও স্যুপ তাদের মুখরোচক খাবার। চালের পিঠা (মুণ্ডি) মগদের বিশেষ পছন্দের খাদ্য। খাবার গ্রহণের পর চা জাতীয় পানি (লেপসি) পান জনপ্রিয় অভ্যাস, যা অনেক দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশে দেখা যায়। বর্মিদের মতো বগরাও নলের সাহায্যে টুরুট পান করে ঘরে তৈরি আরে নামক মদ সীমিত আকারে পানের প্রচলন রয়েছে।
মগ সমাজে পুরুষ সদস্যগণ সাধারণত লুঙ্গি ( সারং), শার্ট ও চটি জুতা ব্যবহার করে এবং তারা খালি পায়ে খুব একটা বের হয় না। উৎসবাদির সময়ে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যগণ গলায় বোতাম দিয়ে আটকানো আঁটোসাঁটো একটি বন্ধ কোট (আঙ্গি পরিধান করে), মাথায় গুওং পুং নামে সাদা রুমালের ব্যবহারও সাধারণভাবে প্রচলিত। দেহের সৌন্দর্যের জন্য মগদের একটা অংশ উল্কির (মতোরয়) ব্যবহার করে। শিক্ষিত অংশ পাজামা/প্যান্ট, শার্ট ও জুতা ব্যবহার করে থাকে। মগ নারীর সাধারণ পোশাক থামি ও আঙ্গি (ব্লাউজ)। নিজেকে আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করার জন্য তারা মাথায় চুং টুং নামে পালকের গোছা ব্যবহার করে থাকে। কখনও কখনও তারা নিজেদের মাথা ফুল ও গয়না দিয়ে সজ্জিত করে। সালোয়ার=কামিজও মগ তরুণীদের জনপ্রিয় পোশাক।
মগরা মাচাং নামে পরিচিত উঁচু স্থানে তাদের বাড়িঘর তৈরি করে থাকে, বাড়িগুলি ডিম্বাকৃতির ছাদসহ আয়তাকার। কাঠ বা বাঁশের দণ্ডের ব্যাস দিয়ে মাটি থেকে ছড় থেকে আট ফুট উচ্চতায় বাঁশাচ্ছাদিত মাচান তৈরি করা হয়। দেয়ালগুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি এবং ঘরের ছাদ খড় দিয়ে আচ্ছাদিত। মাচাং ও ঘরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথের মাঝখানে একটি সিঁড়ি লাগনো থাকে। একটি বাড়ি বেশ কয়েকটি কক্ষে বিভক্ত। সাধারণভাবে বলতে গেলে, মগদের বাড়িগুলিতে আলো-বাতাস চলাচলের বেশ ভাল ব্যবস্থা থাকে। প্রতিটি বাড়ি একটি গেটসহ সবদিক দিয়ে বড়ায় ঘেরা। বেড়ার ভেতরে থাকে একটি বাগান। বান্দরবান অঞ্চলে বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি ঘরগুলি দেখতে সাদামাটা। পক্ষান্তরে, কক্সবাজারের বাড়িগুলির স্থাপত্যশৈলীতে রয়েছে শৈল্পিক আকৃতি ও নকশার সমাহার।
মগদের অধিকাংশই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। সাধারণত তারা দিনে দু’বার স্নান করে এবং প্রায় সর্বদাই ফুটানো পানি পান করে। প্রাচীনকালে তারা গাছপালা ও লতাগল্ম দিয়ে তৈরি দেশীয় ঔষধপত্র গ্রহণ করত। এ ব্যবস্থাটি ‘মঘা শাস্ত্রীয় ঔষধ’ নামে জনপ্রিয়। ইদানীং প্রাচীন ব্যবস্থার পরিবর্তে অ্যালোপ্যাথিক ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছে এবং তরুণ মগরা ক্রমেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা পছন্দ করছে।
মগদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নতুন উৎসাহ ও আশাবাদে অনুপ্রাণিত এবং তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই সংগঠনসমূহ হচ্ছে: বাংলাদেশ রাখাইন কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ মারমা সমিতি, বাংলাদেশ রাখাইন-মারমা সংঘ পরিষদ এবং পটুয়াখালী রাখাইন বৌদ্ধ যুব সংস্থা। সংগঠনসমূহের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে আছে সরকারের কাছে তাদের সমস্যা তুলে ধরা এবং দেশে ও বিদেশে তাদের সংস্কৃতি প্রচান করা। এ উদ্দেশ্যে মগ ও তরুণদের সম্পাদনায় কতিপয় পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী, যেমন: রাখাইন, ভয়েস অব রাখাইন, উচ্চারণ এবং লাইট অফ আওয়াজন ওয়ে ইত্যাদি মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়।
মগদের এলাকায় এনজিওদের তৎপরতা অত্যন্ত সীমিত ছিল। উপজাতীয় অসন্তোষ এবং মগ গ্রামগুলির বিচ্ছিন্ন অবস্থঅন তাদের কাজ করার পক্ষে উপযোগী ছিল না। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্র্যাক এবং প্রশিকার মতো কিছু এনজিও এসব এলাকায় নান কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) নামের এ ক’টি এনজিও মগ অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার উন্নয়ন, তাঁতসহ কুটির শিল্পের উন্নয়ন, দরিদ্র মগনারীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ এবং রাখাইন সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে।
মগ গোষ্ঠী প্রধান |
এর ফলস্বরূপ, আরাকান থেকে দ্বিতীয় দফায় মগদের দেশত্যাগ আরম্ভ হয়, আরাকন থেকে আগত শরণার্থীরা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে একটা স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নেয়। ত্রমে মাতামুহুরী উপত্যকার মধ্য দিয়ে তারা বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়ে। মগরা এই এলাকাকে বোমাং থউং, বা বোমাং রাজার আবাসস্থল বলে অভিহিত করে। তৃতীয় দলটি সীতাকুণ্ড অঞ্চল থেকে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করে এবং রামগড়ে তাদের স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। তারা নিজেদের প্লং থা ও তাদের আবাসস্থলকে প্লং থং বলে দাবি করে। চতুর্থ দলটি বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে বৃহত্তর পটুয়াখালীর (বর্তমানে পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলা) দক্ষিণ অঞ্চলে পৌঁছে এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলে। রাঙ্গাবালি, বড় বাইজদিয়া ও আইলা প্রধান প্রধান মগবসতি ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা অঞ্চলটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মগরা এই এলাকাকে আওয়াজনওয়ে, অর্থাৎ সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপ বলে অভিহিত করে।
বিশেষ করে বান্দরবান ও পটুয়াখালী জেলায় বিগত বছরসমূহে মগ জনসংখ্যা সার্বিকভাবে হ্রাস পায়। ১৯৭৪-১৯৯৭ মেয়অদকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের অসন্তোষ চলাকালে কিছু মগ কতিপয় অন্যান্য উপজাতির সাথে বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চল (যথা বান্দরবান জেলা) থেকে আরাকানে অভিবাসিত হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং মগদের দেশত্যাগ প্রক্রিয়া যথেষ্ট মন্থর হয়েছে। তবে পটুয়াখালীতে ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে কিছু কিছু মগ গ্রাম বিরান হয়ে গেছে। স্থানীয় নানা কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সামাজিক অসন্তোষের কারণে কিছু মগ এখনও দেশান্তরিত হচ্ছে।
মগদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, বর্মি ভাষার সাথে এর বেশ মিল আছে। মগদের সংখ্যা, দিন ও মাসের নাম বর্মি ভাষার মতোই। সাধারণভাবে মগদের নিজস্ব তেমন কোন সমৃদ্ধ সাহিত্য নেই। ধাঁধা, বাগধারা ও লোককাহিনী মগ সমাজে বেশ পরিচিত। ফঙ্গেই (ধর্মযাজক) এবং রোয়া (গ্রামীণ) স্কুল মগ সমাজে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে যৌথভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় মগ এ রাকায় ফঙ্গেই এবং রোয়াদের উপস্থিতির কারণে সাক্ষরতার হার বেশি। মগ সমাজের প্রত্যেক সদস্য বর্মি ভাষা অনর্গল পড়তে ও বলতে পারে। তবে কমিউনিটির নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা খুবিই অপ্রতুল। সে কারণে অনেক মগ ছেলে-মেয়েকে এলকার ভিতরে ও বাইরে সাধারণ স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করতে দেখা যায়।
মগদের প্রধান পেশা কৃষি। পাহাড়ি এলকায় তারা জুমচাষ করে এবং সমতল এলাকায় লাঙল দিয়ে চাষাবাদ করে। তাঁত বুনে এবং মাছ ধরেও অনেকের জীবিকা চলে। তাদের সমাজে ব্যবসায়ী, দোকানদার এবং চাকরিজীবির সন্ধান কদাচিৎ পাওয়া যায়। শিশুশ্রম তাদের মধ্যে অজানা, কিন্তু মগ নারীদের মাঠে ও বিভিন্ন স্থাপণা নির্মাণস্থলে কাজ কতে দেখা যায়।
মগদের সমাজকাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারের সর্বেসর্বা হচ্ছে জ্যেষ্ঠতম পুরুষ সদস্য। তথাপি মগ সমাজে নারীর একটা সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে। স্বামীর আবাসে স্ত্রীর অবস্থান প্রথাগত রীতি হলেও স্ত্রীর বাড়িতে স্বামীর অবস্থানের ঘটনাও একেবারে নির্লক্ষ্য নয়। একজন মগ নারী বিয়ে, বিবাহ বিচ্ছেদ িএবং সম্পত্তির ওপর মালিকানার ক্ষেত্রে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। অসবর্ণ এবং অন্তঃবর্ণ এই দু’ধরনের বিয়েই মগ সমাজে প্রচলিত আছে। বিধবা বিয়েও মেনে নেওয়া হয়। মগ সমাজ মারোথা, রাগ্রাথা, রামরায়্যাথা ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত। মগদের ভিক্ষু ধনপতিদের মৃতদেহ বেশ জাঁকজমকের সাথে দাহ করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মৃতদেহ মাটিতে দাফন করা হয়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধগণের মতোই মগরাও থেরবাদ (হীনযান) শ্রেণীর বৌদ্ধ। পালি ভাষায় লিখিত ত্রিপিটক হচ্ছে মগদের পবিত্র গ্রন্থ। ধর্মীয় বিষয়াবলির ক্ষেত্রে তারা দু’দলে বিভক্ত; সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং অপেশাদার সম্প্রদায় বা লেইতি। ভিক্ষুগণ কৌমার্যব্রত পালন করে, গেরুয়া রঙের ঢিলেঢালা বস্ত্র পরিধান করে এবং সন্ন্যাস আশ্রমে বাস করে। পক্ষান্তরে লেইতিগণ স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পারিবারিক জীবনযাপন করে।
মগদের অধিকাংশ উৎসবই প্রতি মাসের পূর্ণিমার সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাকে তারা বর্মি শব্দে লবরয় বলে। তাদের কাছে পূর্ণমা পবিত্র। তারা মনে করে, অধিকাংশ ধর্মীয় ঘটনাবলি মাসের কোন না কোন পূর্ণিমা রাত বা দিনে ঘটেছে। এ উপলক্ষে খাদ্র-দ্রব্য, ফল-মূল, ফুল এবং মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে প্রভু বুদ্ধের মূর্তি পূজা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণিমাসমূহরে মধ্যে রয়েছে বাসন (বৈশাখ), ওয়াসো (আষাঢ়), থাড়িংয়ুত (আশ্বিন) এবং বাবোড়ুই (মাঘী)। তারা ছাত্রদের দান-দক্ষিণা দেয়, সিলা (আচরণবিধি) ও ভাবনা (ধ্যানসাধানা) পালন করে। এ সকল বৌদ্ধধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি তারা প্রাকৃত পূজার প্রথানুযায়ী গাছপালা এবং বড় বড় নদীর উপাসনা করে।
মগদের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হচ্ছে পানি উৎসব। জাতপোয়ে নামক পালা ও ইয়েনপোয়ে নামক নৃত্য হচ্ছে জনপ্রিয় বিনোদন। পালাটি বৌদ্ধদের জ্ঞান ও প্রাচীন বৌদ্ধ রাজাদের জীবনগাথার সাথে যুক্ত, পকষান্তরে উক্ত নৃত্যটি পশ্চাত্য বল নৃত্যের সমপর্যায়ভুক্ত। লোকসংখ্যা হ্রাসের সাথে সাথে এ সকল উৎসব উৎদাপন কমে গেছে। মগদের সঙ্গীত যন্ত্রসমূহের মধ্যে সেইং ওয়েইং (বৃত্তাকার বড় আকৃতির কাঠের ঢোল), কিয়ে ওয়েইং (ছোট আকৃতির কাঠের ঢোল), পিলিঈ (বাঁশি) এবং ঝিনে গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল যন্ত্রের সাথে বার্মায় ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের মিল রয়েছে।
ভাত, সবজি ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণ মরিচ ও লবণ হচ্ছে মগদের প্রধান খাদ্য। তারা দিনে দু’বেলা আহার গ্রহণ করে। নাপ্পি (বাসি মাছ) ও স্যুপ তাদের মুখরোচক খাবার। চালের পিঠা (মুণ্ডি) মগদের বিশেষ পছন্দের খাদ্য। খাবার গ্রহণের পর চা জাতীয় পানি (লেপসি) পান জনপ্রিয় অভ্যাস, যা অনেক দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশে দেখা যায়। বর্মিদের মতো বগরাও নলের সাহায্যে টুরুট পান করে ঘরে তৈরি আরে নামক মদ সীমিত আকারে পানের প্রচলন রয়েছে।
মগ সমাজে পুরুষ সদস্যগণ সাধারণত লুঙ্গি ( সারং), শার্ট ও চটি জুতা ব্যবহার করে এবং তারা খালি পায়ে খুব একটা বের হয় না। উৎসবাদির সময়ে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যগণ গলায় বোতাম দিয়ে আটকানো আঁটোসাঁটো একটি বন্ধ কোট (আঙ্গি পরিধান করে), মাথায় গুওং পুং নামে সাদা রুমালের ব্যবহারও সাধারণভাবে প্রচলিত। দেহের সৌন্দর্যের জন্য মগদের একটা অংশ উল্কির (মতোরয়) ব্যবহার করে। শিক্ষিত অংশ পাজামা/প্যান্ট, শার্ট ও জুতা ব্যবহার করে থাকে। মগ নারীর সাধারণ পোশাক থামি ও আঙ্গি (ব্লাউজ)। নিজেকে আকর্ষণীয় ও মোহনীয় করার জন্য তারা মাথায় চুং টুং নামে পালকের গোছা ব্যবহার করে থাকে। কখনও কখনও তারা নিজেদের মাথা ফুল ও গয়না দিয়ে সজ্জিত করে। সালোয়ার=কামিজও মগ তরুণীদের জনপ্রিয় পোশাক।
মগরা মাচাং নামে পরিচিত উঁচু স্থানে তাদের বাড়িঘর তৈরি করে থাকে, বাড়িগুলি ডিম্বাকৃতির ছাদসহ আয়তাকার। কাঠ বা বাঁশের দণ্ডের ব্যাস দিয়ে মাটি থেকে ছড় থেকে আট ফুট উচ্চতায় বাঁশাচ্ছাদিত মাচান তৈরি করা হয়। দেয়ালগুলি বাঁশ দিয়ে তৈরি এবং ঘরের ছাদ খড় দিয়ে আচ্ছাদিত। মাচাং ও ঘরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথের মাঝখানে একটি সিঁড়ি লাগনো থাকে। একটি বাড়ি বেশ কয়েকটি কক্ষে বিভক্ত। সাধারণভাবে বলতে গেলে, মগদের বাড়িগুলিতে আলো-বাতাস চলাচলের বেশ ভাল ব্যবস্থা থাকে। প্রতিটি বাড়ি একটি গেটসহ সবদিক দিয়ে বড়ায় ঘেরা। বেড়ার ভেতরে থাকে একটি বাগান। বান্দরবান অঞ্চলে বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি ঘরগুলি দেখতে সাদামাটা। পক্ষান্তরে, কক্সবাজারের বাড়িগুলির স্থাপত্যশৈলীতে রয়েছে শৈল্পিক আকৃতি ও নকশার সমাহার।
মগদের অধিকাংশই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। সাধারণত তারা দিনে দু’বার স্নান করে এবং প্রায় সর্বদাই ফুটানো পানি পান করে। প্রাচীনকালে তারা গাছপালা ও লতাগল্ম দিয়ে তৈরি দেশীয় ঔষধপত্র গ্রহণ করত। এ ব্যবস্থাটি ‘মঘা শাস্ত্রীয় ঔষধ’ নামে জনপ্রিয়। ইদানীং প্রাচীন ব্যবস্থার পরিবর্তে অ্যালোপ্যাথিক ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছে এবং তরুণ মগরা ক্রমেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা পছন্দ করছে।
মগদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নতুন উৎসাহ ও আশাবাদে অনুপ্রাণিত এবং তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই সংগঠনসমূহ হচ্ছে: বাংলাদেশ রাখাইন কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ মারমা সমিতি, বাংলাদেশ রাখাইন-মারমা সংঘ পরিষদ এবং পটুয়াখালী রাখাইন বৌদ্ধ যুব সংস্থা। সংগঠনসমূহের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে আছে সরকারের কাছে তাদের সমস্যা তুলে ধরা এবং দেশে ও বিদেশে তাদের সংস্কৃতি প্রচান করা। এ উদ্দেশ্যে মগ ও তরুণদের সম্পাদনায় কতিপয় পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী, যেমন: রাখাইন, ভয়েস অব রাখাইন, উচ্চারণ এবং লাইট অফ আওয়াজন ওয়ে ইত্যাদি মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়।
মগদের এলাকায় এনজিওদের তৎপরতা অত্যন্ত সীমিত ছিল। উপজাতীয় অসন্তোষ এবং মগ গ্রামগুলির বিচ্ছিন্ন অবস্থঅন তাদের কাজ করার পক্ষে উপযোগী ছিল না। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্র্যাক এবং প্রশিকার মতো কিছু এনজিও এসব এলাকায় নান কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) নামের এ ক’টি এনজিও মগ অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার উন্নয়ন, তাঁতসহ কুটির শিল্পের উন্নয়ন, দরিদ্র মগনারীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ এবং রাখাইন সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া