শৈশবে নানু-দাদু-মার কাছে আমরা যত গল্প শুনি তার কিছু থাকে জলদস্যুর নির্মমতা বিষয়ক। তাই ‘ভাইকিং জলদস্যু’ শিরোনাম পড়ে ভয়ংকর অনুভূতি তৈরি হতে পারে। কেউ কেউ চলে যেতে পারি শৈশবের গল্প-জগতে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। ভাইকিং জলদস্যু আমাদের মনে ভয়ংকরের জায়গায় তৈরি করে রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
পদে পদে বিপদ আর মৃত্যুর হাতছানি মাড়িয়ে হাজার হাজার বছর আগে যেসব মানুষ সমুদ্র-পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুঁজে দিয়েছেন নতুন ঠিকানা ভাইকিং জলদস্যু তাদের অন্যতম। বলা যায় অগ্রপথিক। অথচ ক্রিস্ট্রফার কলম্বাসকে আমরা যতটুকু জানি, ভাস্কো-দা-গামা আমাদের কাছে যে রূপে পরিচিত ভাইকিং বিয়ার্ন হারজুল্ফ্সন অথবা লীফ এরিকসন তত নয়। যদিও কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের প্রায় ৫০০ বছর আগে এ দুই ভাইকিং আলাদাভাবে উত্তর আমেরিকার উপকূলে হাজির হয়েছিলেন।
বর্তমানে আধুনিক ও সুসভ্য জাতি হিসেবে নরওয়েজিয়ানদের পরিচিতি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দেশ হিসেবেও নরওয়ের পরিচিতি অনুরূপ। নরওয়ের অধিবাসী নরওয়েজিয়ানদেরই পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ভাইকিং। হাজার হাজার বছর আগে সমুদ্রে দস্যুবৃত্তি ছিল তাদের পেশা। অসীম সাহস আর নৌযান নির্মাণের দক্ষতা ছিল তাদের পুঁজি। সমুদ্রভীতি না থাকায় তারা সহজে সমুদ্রাভিযান পরিচালনা করে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথে এগিয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ছিল ব্যাপক। অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ শতকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের (নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন) সমুদ্রে তাদের ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। জনসংখ্যার আধিক্যেরও কারণে এক সময় তারা নিজেদের সীমানার বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে পাড়ি দেয়। জাহাজ তৈরি এবং চালনায় অসাধারণ দক্ষতা বিপজ্জনক অভিযানে তাদের অনুপ্রাণিত করে। ৮৬৫ সালের মধ্যে তারা ইস্ট অ্যাংলিয়া (ইংল্যান্ডের অংশ), নর্থামব্রিয়া (উত্তর ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ স্কটল্যান্ডের অংশ) এবং মার্সিয়ার (ইংলিশ মিডল্যান্ড) অধিকাংশ দখল করে নেয়। এ দখল স্থায়ী না হলেও ইংরেজদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে ভাইকিংদের প্রভাব স্থায়ী হয়েছিল। নবম শতকের শেষার্ধে ভাইকিংরা গ্রিণল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, উত্তর আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে। এ শতকের শেষে ৯০০ সালে তারা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। এ আইসল্যান্ড থেকেই অভিযান পরিচালনা করে ভাইকিংরা উত্তর আমেরিকা পৌঁছেছিলেন।
প্রথম উত্তর আমেরিকা উপকূলে পৌঁছেছিলেন বিয়ার্ন হারজুল্ফ্সন নামক ভাইকিং জলদস্যু। মজার বিষয় হল তার গন্তব্য আমেরিকা ছিল না। তিনি পিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য আইসল্যান্ড থেকে সমুদ্রে জাহাজ ভাসালে ঝড়ের মুখে পড়েন। তীব্র বাতাসে তার জাহাজ উত্তর-পশ্চিমে ভেসে যায়। এক উপকূলে পৌঁছে তিনি ভেবেছিলেন তা গ্রিনল্যান্ড। আসলে তিনি পৌঁছেছিলেন নাম না জানা এক নতুন স্থানে। পরে সেখান থেকে ফিরে এসে পরিচিতজনদের কাছে নতুন স্থানটির বিবরণ দেন। এতে অনেকেই নতুন স্থানের বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বিয়ার্নের অভিযানের কয়েক বছর পর নরওয়ে থেকে আরেক ভাইকিং লীফ এরিকসন ভাই থরভোল্টসহ নতুন স্থানটির উদ্দেশে যাত্রা করেন। তার কাঠের জাহাজ ১০০০ সালে উত্তর আমেরিকার লাব্রাডরের উপকূলে পৌঁছে। অঞ্চলটিতে প্রচুর পরিমাণে আঙুরের ফলন দেখে তিনি এর নাম রাখেন Vineland বা অঙুর রাজ্য। আঙুর রাজ্য থেকে আরও দক্ষিণে তিনি বর্তমান ম্যাসাচুসেট্স পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এভাবে কলম্বাসের প্রায় ৫০০ বছর আগে ভাইকিং জলদস্যুরা আবিষ্কার করেন আমেরিকা। এ ঘটনার প্রায় ছয় বছর পর মেক্সিকোতেও ভাইকিংরা অভিযান চালায়। সেখানে তারা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বলেও জানা যায়। তাই ভৌগোলিক আবিষ্কারের ইতিহাসে ভাইকিংদের নাম অবশ্যই যুগযুগ ধরে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হবে।
ড. এটিএম আতিকুর রহমান
প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর