অলিম্পিক মশাল নিয়ে নানা কথা

অলিম্পিক গেমের মূল আকর্ষণ হল মশাল। প্রতি অলিম্পিকের আগে একটি মশালের মাথায় জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা নানা জায়গা ঘুরে উপস্থিত হয় যে শহরে অলিম্পিক হবে সেখানে। অলিম্পিকের অমর চেতনার প্রতীক এই শিখার যাত্রা শেষ হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, স্টেডিয়ামের চূড়ায় অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে।

এরপর তা জ্বলতে থাকে ১৪ দিন ধরে, যা নেভানো হয় অলিম্পিকের শেষ দিন। ৭০ দিনের একটি রিলে শেষে এক হাজার ৮০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আগামী ২৭ জুলাই লন্ডন পৌঁছবে মশালটি। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমুদ্রতীর থেকে শুরু হবে মশালযাত্রা। আগামী ৭০ দিন গ্রেট ব্রিটেনের এক হাজারের ওপর শহর, নগর ও গ্রাম পরিক্রম করবে এই মশাল। ল্যান্ডস্্ অ্যান্ড কর্নওয়ালে প্রথম মশাল জ্বালানো হবে গ্রিস থেকে আনা মশালের আগুনে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে এই মশাল নিয়ে যাবে ৮ হাজার মশালবহনকারী। প্রথম মশাল বহনকারী (torchbearer) হলেন ইয়াচসম্যান বেন আইনসিলি। তিনটি অলিম্পিক সোনাজয়ী এই নাবিক ক্রীড়াবিদ যখন ইংল্যান্ডের রাস্তায় মশাল নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন তখন জনতার উন্মাদনা ছিল দেখার মতো। ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এই দৌড়ের ছবি। লন্ডনে তো এই মশালের দৌড় কভার করতে ২৪ ঘণ্টার চ্যানেল পর্যন্ত খোলা হয়েছে। চার বছর পর পর এই জাঁকালো অনুষ্ঠান এখন আমরা পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে টিভিতে সরাসরি দেখি, অলিম্পিক শিখার পৃথিবী পরিভ্রমণের খবরও পড়ি। কিন্তু কোথায়, কখন, কিভাবে জ্বালানো হয় এই অলিম্পিক শিখা? উত্তর জানতে যেতে হবে পশ্চিম গ্রিসের অলিম্পিয়া নামে একটি জায়গায়। যেখানে প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন অলিম্পিকের সূচনা হয়েছিল। এখানেই ঘণ্টাখানেকের একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো থেকে জ্বালানো হয় সেই অগ্নিশিখা। আর এই শিখা ক্রীড়ানুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কখনোই নেভে না। এই অলিম্পিয়াতেই ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল প্রাচীন যুগের অলিম্পিক। প্রতি চার বছর পর পর এই গেমের আয়োজন করা হতো। সেখানে ছিল গ্রিক দেবতাদের রাজা জিউসের মন্দির। তার সম্মানেই অনুষ্ঠিত হতো ক্রীড়ানুষ্ঠান। আজ সে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানেই অলিম্পিকের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হয় শিখা প্রজ্বলনের অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকেন অলিম্পিক আয়োজক কর্মকর্তারা, ক্রীড়াবিদ এবং কিছু দর্শক। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের শিখা প্রজ্বলন অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পিয়ায় দেবতা জিউসের স্ত্রী হেরার মন্দিরের সামনে। এক সপ্তাহ ধরে ওই শিখাটি গ্রিসের নানা স্থানে পরিভ্রমণ করে। তার পরে এথেন্সে যে স্টেডিয়ামে ১৮৯৬ সালে আধুনিক যুগের প্রথম অলিম্পিক হয়েছিল সেখানে এক অনুষ্ঠানে তা তুলে দেয়া হয় লন্ডন অলিম্পিকের আয়োজকদের হাতে। এক বিশেষ বিমানে করে তা নিয়ে আসা হয় ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে। ৭০ দিন ধরে তা হাতে হাতে ঘুরে ৮ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেবে ব্রিটেনের নানা জায়গায়। তার পর অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন তা প্রবেশ করবে লন্ডনে। এই পুরো প্রক্রিয়াটির সূচনা হবে অলিম্পিয়ায় শিখা প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে। এটি সম্পাদন করবেন প্রাচীন রোমান রীতির সাদা পোশাক পরা এগারো জন গ্রিক মহিলা। আগুন জ্বালানো হয় মাটিতে রাখা একটি অবতল আয়না থেকে। এতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এমন তাপের সৃষ্টি করা হয়, যা থেকে মশাল জ্বালানো যায়। এগারোজন মহিলার মধ্য থেকে একজন শিখা প্রজ্বলন করেন। এরপর তা থেকে জ্বালানো হয় আরেকটি অলিম্পিক মশাল। এই মশালটি তুলে দেয়া হয় একজন ক্রীড়াবিদের হাতে। এ ছাড়াও তুলে দেয়া হয় একটি জলপাই গাছের শাখা। আরেকজন উড়িয়ে দেন শান্তির প্রতীক একটি সাদা পায়রা। প্রাচীনকালের অলিম্পিকে ইভেন্টের মধ্যে থাকত দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি, রথচালনা ইত্যাদি। প্রতিযোগিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বলত একটি আগুনের শিখা, যা ছিল দেবতাদের রাজা জিউসের কাছ থেকে প্রমিথিউসের আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়ে দেয়ার কাহিনীর স্মারক। বর্তমানের অলিম্পিক মশাল সেই ঐতিহ্যেরই এক ধারাবাহিকতা। ১৯২৮ সালের আমস্টারডাম অলিম্পিক থেকে এই অলিম্পিক মশাল জ্বালানোর প্রথা শুরু হয়। তবে এ যুগে যেভাবে গ্রিস থেকে এই অগ্নিশিখা দীর্ঘ পথ ঘুরে হাত বদল হতে হতে অলিম্পিক স্টেডিয়াম পর্যন্ত পৌঁছায় এই ‘টর্চ রিলে’ প্রথা অবশ্য শুরু হয় ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক থেকে। চলার পথে মশালের আগুন যে কখনোই নেভে না তা পুরোপুরি ঠিক নয়। কখনও কখনও তা নিভে যায় ঠিকই, কিন্তু মশালবাহীরা সঙ্গে রাখেন ওই একই আগুনে জ্বালানো একটি ছোট্ট লণ্ঠন। এখান থেকে আবার মশাল জ্বালিয়ে নেয়া হয়। অলিম্পিকের উৎসভূমি অলিম্পিয়ার ওই প্রাচীন জায়গাটি এক সময় আট মিটার মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। ১৭৬৬ সালে ইংরেজ ইতিহাসবিদ রিচার্ড শ্যান্ডলার খুঁজে বের করেন এই অলিম্পিয়া। ১৮২৯ সালে প্রথম খনন কাজ শুরু হয়। আর তার পর একে একে উদ্ঘাটিত হয়েছে প্রাচীন অলিম্পিয়ার একাধিক ভবনের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৯০-এর দশকেও এখানে খনন কাজ হয়েছে। জায়গাটি এখন ইউনেস্কোর একটি অন্যতম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।