পুরোনো দিনের ছবিতে মানুষ কেন হাসত না!

‘রামগরুড়ের ছানা/হাসতে তাদের মানা,/হাসির কথা শুনলে বলে,/ “হাসব না না, না না”।’ সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সুকুমার রায় কাকে দেখে এ ছড়া লিখেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন। উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মুখের হাসিই উবে যাওয়ার জোগাড়! হঠাৎ মনে হলো, স্বয়ং সুকুমারের মুখচ্ছবিটাই দেখি না কেন! গুগলের সার্চ অপশনে ‘সুকুমার রায়’ লিখে এন্টার বাটন প্রেস করা হলো। ইমেজ অপশনে ক্লিক করতেই গুগল মহাশয় হাজির করল সুকুমারের বেশ কিছু ছবি। সেগুলো ঘেঁটে অবশেষে বিখ্যাত এই শিশুসাহিত্যিকের মোটে তিনটি ছবি পাওয়া গেল। মজার বিষয় হলো, তিনটি ছবিতেই সুকুমার বড্ড গম্ভীর। মুখে হাসির ‘হ’-ও নেই। তখন আবারও ওই রামগড়ুরের ছানা মাথায় টোকা দিল!
পুরোনো দিনের সেই গোমড়া মুখের একটি পোর্ট্রেট
পুরোনো দিনের সেই গোমড়া মুখের একটি পোর্ট্রেট
কেবল সুকুমার নন, অমন ‘সমস্যা’ ছিল তাঁর আমলের প্রায় সবারই। একটু খেয়াল করলেই আবিষ্কার করবেন, পুরোনো দিনে ছবি তোলার সময় মানুষের মুখে কেন জানি রাজ্যের বিষণ্নতা ভর করত, চোখে থাকত অজানা আশঙ্কা, চোয়ালে ইস্পাতের কাঠিন্য। অতীতে মানুষ ছবি তোলার সময় হাসত না কেন? এ প্রশ্ন কেবল আপনার কিংবা আমার নয়; গুগলও বলছে, এই প্রশ্ন করতে করতে মানুষ তার ‘কান’ ঝালাপালা করে দিয়েছে!

এবার তাহলে একটু ইতিহাস ঘাঁটা যাক। সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালে। আর যুক্তরাজ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে আলোকচিত্র ধারণের চল শুরু হয় ১৮৩৯ সালের দিকে। রানী ভিক্টোরিয়ার আমল ছিল সেটা। অতএব সুকুমারের জন্মের সময় আলোকচিত্র-প্রযুক্তির বয়স ছিল প্রায় ৫০। সে সময়েও মানুষ ছবি তোলার সময় মুখ গম্ভীর করে বসে থাকত। ফলে সুকুমার কিংবা তাঁর আশপাশের বয়সের মানুষেরাও ছবি তোলার সময় ‘রামগরুড়ের ছানা’ বনে যেতেন। এসব দেখেই সুকুমার ছড়াটি লিখেছিলেন কিনা, কে জানে!
জেরোম কে জেরোম
জেরোম কে জেরোম
তবে এটা জানা গেছে যে ১৯ শতকের আগ পর্যন্ত ছবি তোলার সময় মানুষ তাদের মুখ ‘বাংলার পাঁচ’ করে রাখত। ইতিহাস ঘাঁটলেই এর প্রমাণ মেলে। এদিকে, যে ভিক্টোরিয়ানরা আলোকচিত্র বা ছবি তোলার চল শুরু করেছিলেন, তাঁরা কিন্তু মোটেও বেরসিক ছিলেন না। এরও ভূরি ভূরি প্রমাণ মেলে ইতিহাস কিংবা সে সময়ে লেখা বইপত্রে চোখ বোলালে। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক জেরোম কে. জেরোমের কথাই ধরা যাক। ১৮৮৯ সালে তিনি লিখলেন বিখ্যাত রম্য উপন্যাস ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’। উপন্যাসের একটা জায়গায় কলেরা নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি লেখক। অথচ কয়েক দশক আগেও কিন্তু লন্ডনের হাজারো মানুষ মারা গিয়েছিল কলেরা রোগেই। আজও সেই উপন্যাস সারা বিশ্বে সমাদৃত এর দুর্দান্ত ও কালোত্তীর্ণ রসিকতার জন্য। এবার লেখক জেরোম কে. জেরোমের ছবি খুঁজে দেখুন, শেষ বয়সের একটি-দুটি বাদে সব ছবিতেই মুখে সেই ‘প্রয়োজনীয়’ গাম্ভীর্য!

লেখার এ পর্যায়ে এসে, আমাদের সেই ‘কমন’ প্রশ্নের একটা ঝাপসা উত্তর মিলছে। ওই যে ‘প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্য’! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোনো দিনে ছবি তোলার সময় ওই গাম্ভীর্য প্রয়োজনীয়ই ছিল বটে। কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো— সে সময় ছবি তোলার বিষয়টিই ছিল দুর্লভ, ব্যয়বহুল ও জটিল এক ‘শখ’। ছবি তোলা-তুলি তখন কেবল অভিজাত শ্রেণিরই ব্যাপার-স্যাপার ছিল। ফলে ‘আদার ব্যাপারি’ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সে সময় ছবি তোলা মানে ছিল জাহাজের ডেকে বসে হাওয়া খাওয়ার মতো বিলাসী ব্যাপার! অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ক্যামেরার সামনে না হয় দাঁড়ানো গেল, কিন্তু একবারের চেষ্টায় তা সফল হবে তো? তখন এমন দুশ্চিন্তাও কাজ করত সবার মনে। হাসতে গিয়ে বা নড়াচড়া করতে গিয়ে ছবিটা ভেস্তে গেলেই ‘মহামূল্যবান’ শখের দফারফা। আবার এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যারা হয়তো জীবনে একবারই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর কপাল নিয়ে জন্মেছিলেন! আর ছবি তোলার প্রযুক্তি চালু হওয়ার আগে ধনীরা নিজেদের ছবি আঁকিয়ে নিতেন শিল্পীদের দিয়ে। এই ব্যয়বহুল বিষয়টি মধ্যবিত্তরা কখনো স্বপ্নেও দেখত কিনা সন্দেহ। তাই ছবি তোলার ব্যাপারটা তাদের কাছে ছিল শিল্পীকে দিয়ে পোর্ট্রেট করিয়ে নেওয়ার মতোই মহামূল্যবান এক শিল্প!
রানি ভিক্টোরিয়ার মুখেও হাসি নেই!
রানি ভিক্টোরিয়ার মুখেও হাসি নেই!
কেবল আর্থিক সংগতির বিচারেই নয়, যান্ত্রিক বিষয়-আশয়ও ছিল এর আরেকটি কারণ। সে সময়ের ক্যামেরাগুলোর আচরণ ছিল গন্ডারের সহোদরের মতোই। কেতাবি ভাষায় ক্যামেরার ‘এক্সপোজার টাইম’ ছিল দীর্ঘসূত্রতার সার্থক উদাহরণ। আলোকচিত্রী হয়তো ক্যামেরায় ক্লিক করলেন, ছবি তুলতে আসা মানুষেরা চোয়াল শক্ত করে, চোখের পলক না ফেলে, দম আটকে বসে আছেন। এর মাঝে হয়তো পিঠের দিকটায় একটা মশা কামড়াচ্ছে, তারপরও সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই! গলা শুকিয়ে কাঠ, একটা ঢোক গেলা দরকার, সে প্রয়োজনটাও হয়তো গিলে ফেলতেন অনেকেই। তারপর এক সময় ক্যামেরা তার কাজ শেষ করত, ফ্রেমে বন্দী হতেন ‘আমজনতা’। সেই ছবিই তাদের জন্য হয়ে থাকত কালের সাক্ষী! জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, শব্দ একটু এদিক-সেদিক করে হয়তো তাঁরা আবৃত্তি করতে পারতেন, ‘সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়/কী কাজ করেছি আর কী ‘‘ছবি তুলেছি’’!’
সুকুমার রায়
সুকুমার রায়
পুরোনো দিনে ছবি তোলার সময় মানুষ কেন হাসত না?-এ প্রশ্নের তো একটা মোটামুটি চলনসই উত্তর মিলল; কিন্তু তারপরও গুগল আরেকটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে ক্লান্ত। সেটা হচ্ছে— পুরোনো দিনের ছবির ওই মানুষগুলো কী দুঃখী ছিলেন? আমাদের এখনকার হাসিমুখ সেলফিগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে তো এক কথাতেই জবাব দেওয়া যায়, অবশ্যই অতি দুঃখী ছিলেন! কিন্তু আসলেই কী তাই? বিশেষজ্ঞদের দাবি, পুরোনো দিনের মানুষেরা ছবি তোলার সময় ‘সিরিয়াস’ থাকতেন, তাই বলে দুঃখী ছিলেন, এমন দাবি করা যায় না! তবে প্রশ্নটা এখন বুমেরাং হয়ে আমাদের দিকেই আসছে— আমরা যে প্রতিদিন হাসি হাসি মুখে এত সেলফি তুলছি, আমরা কী সুখী? বিশেষজ্ঞদের দাবি, দুঃখ-কষ্ট আড়াল করার অন্যতম মুখোশের নাম সেলফি!
পারিবারিক ছবি কিন্তু সবার মুখ দেখে মনে পড়বে সুকুমার রায়ের লেখা সেই ‘রাম গরুড়ের ছানা/ হাসতে তাদের মানা’
পারিবারিক ছবি কিন্তু সবার মুখ দেখে মনে পড়বে সুকুমার রায়ের লেখা সেই ‘রাম গরুড়ের ছানা/ হাসতে তাদের মানা’
সুকুমারের ছড়া দিয়ে শুরু, শেষ করা যাক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের ছড়া দিয়ে। (সেলফির হাসিমুখগুলো দেখে আপনি যদি মুখ গোমড়া করে রাখেন, তাহলে এই ছড়া আপনার জন্যই!)

‘...এত হাসি দেখেও যারা/গোমড়া মুখে চায়/তাদের দেখে প্যাঁচার মুখে/কেবল হাসি পায়।’
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, যুক্তরাজ্য
প্রথম-আলো থেকে সংগৃহীত