আজব এই পৃথিবীতে কখন কী যে ঘটে তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। বিচিত্র আর রহস্যময় নানান উপাদানের খোরাক আমাদের এই মহাবিশ্ব। দেশে দেশে বিভিন্ন সময় দেখা যায় অন্যদের থেকে আলাদা এমন কিছু জিনিস। আবার এমনও ঘটে যে এমন কিছু জিনিস সবার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে, তা আগে কোনওদিন কেউ দেখিনি। যেমন বলা যায় ‘সি মংক’-এর কথা। সি মংক হচ্ছে এক ধরনের দৈত্য। যা একদিন জাপানের সমুদ্র উপকূলে হঠাৎ ভেসে উঠেছিল। পোশাক পরিহিত একজন ভিক্ষু যেমন দেখতে হয় ঠিক ভেসে ওঠা দৈত্যটিও তেমন দেখতে ছিল। মাঝে-মধ্যেই দৈত্যটিকে দেখা যেত উপকূলীয় জলে ভেসে বেড়াতে। কয়েকদিন ভেসে বেড়ানোর পরে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিস্ময়কর এ দৈত্যের কথা। ভিক্ষুর মতো দেখতে বলে এ প্রাণীর নাম হয়ে যায় ‘সি মংক’ যার বাংলা অর্থ ‘সমুদ্রভিক্ষু’।. কালের বিবর্তনে অদ্ভুত দর্শন এই প্রাণীটি লোককাহিনীর উপাদানে পরিণত হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সি মংকের নানা কল্পকাহিনী। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিস্তৃত হয় গল্পের পত্রপল্লব।
সমুদ্রভিক্ষু নামের এই আজব প্রাণী নিয়ে দেশে দেশে আজও ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন লোককাহিনী। জাপানিরা সি মংক বা সমুদ্রভিক্ষুকে তুলনা করে সমুদ্রের জীবনীশক্তি রূপে। অনেকে একে বলে সমুদ্রের প্রাণ। আবার অনেকে একে সমুদ্রের শক্তি বলে মনে করেন। তাদের ভাষায়, সমুদ্রভিক্ষু মানে উমিবজু।
গবেষকরা মনে করেন, ১৫৪৬ সালের দিকে ডেনমার্কের সমুদ্র উপকূলে প্রথম দেখা মেলে সমুদ্রভিক্ষুর। একে তখন সামুদ্রিক দানবরূপী এক প্রজাতির মাছ ভাবা হত। এর চমৎকার ধারণা আর চিত্রের নিদর্শন মেলে কনরাড জেসনারের বিখ্যাত হিস্টোরিকা এনিম্যালিয়াম নামক গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে। তাদের মতে, ১৫৩১ সালে পোল্যান্ডের উপকূলে এর দেখা মেলে। তবে এশিয়ার মধ্যে সবার আগে জাপানেই এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সমুদ্রদেবতা হিসেবে অনেক জাপানি একে পূজা করত। সমুদ্র্রসন্ন্যাসী সি মংক নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কল্পকাহিনী। আঁকা হয়েছে অনেক চিত্রও। তবে সি মংকে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় করে গেছেন তার নাম গুইলাউমি ডু বারটাস। তার মহাকাব্যে তিনি দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন সি মংক সম্পর্কে। স্টিনস্ট্রাপ নামের একজন ড্যানিশ প্রাণিবিজ্ঞানী ষোল শতকে আঁকা ‘সি মংক’-এর দুটি চিত্রের তুলনা করে এটিকে দৈত্যাকার স্কুইড রূপে আখ্যায়িত করেন। লেখক রিচার্ড এলিসের লেখা থেকে জানা যায়, বিজ্ঞানী স্টিনস্ট্রাপ ১৮৫০ সালে এ মতবাদ দেন।
রহস্য প্রাণিবিজ্ঞানী বার্নার্ড হিউভেলম্যান্স মনে করেন, সমুদ্রভিক্ষু আসলে বিপথগামী সিন্ধুঘোটক। এখন অবশ্য কেউ কেউ একে দৈত্যাকার হাঙ্গর বলেও আখ্যায়িত করছেন। সি মংক যে শুধু জাপানে দেখা গেছে তা নয়, এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমুদ্র উপকূলে দেখা গেছে।
বিভিন্ন দেশে সমুদ্রভিক্ষুকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। ব্রিটিশরা বলে মংক ফিস আর নরওয়েতে একে শুধু ‘মংক’ নামেই ডাকা হয়। কোথাও একে বলা হয় ধূসর সিল, টুপিওয়ালা সিল, মংক সিল অথবা জেনি হ্যানিভারও। সি মংক-এর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে Sguatina
sguatine।
সি মংক সবার কাছে একটি রহস্যময় প্রাণী। সি মংক যে আসলেই কী সেটা আজও কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেননি। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন এগুলো এক জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী। এগুলো কোথা থেকে আসে সেটিও রহস্যের বিষয়। তারপরও যেসব স্থানে এটিকে দেখা গেছে সেখানের জনসাধারণ এটিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখেছে। অনেকে একে পূজা-অর্চনাও করে থাকে।