পল্লী অর্থসংস্থান প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ ও একত্রীকরণ এবং ঐ তহবিল পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তাদের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলি পরিচালনার জন্য সরবরাহকরণ। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ উভয় প্রকার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ে পল্লী অর্থসংস্থান কার্যক্রম গঠিত। পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থা পল্লীর দরিদ্র জনগণকে ক্ষুদ্রাকারে আর্থিক সেবা প্রদান করে। অপরপক্ষে, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণসহ পল্লী অঞ্চলে অবস্থিত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে পল্লী অর্থসংস্থান প্রক্রিয়ায় তহবিল ও বিভিন্ন আর্থিক সেবা প্রদান করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় আবর্তমান সঞ্চয় সমিতি (রোসকা), ঋণদান সমিতি, আর্থিক সমবায় সমিতি, পল্লী ব্যাংক এবং কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ নানাবিধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থা গঠিত। দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়নের জন্য পল্লী অর্থসংস্থান একটি আবশ্যকীয় এবং কার্যকর উপায়।
পল্লী তহবিল বা পল্লী ঋণ গ্রহিতাদের সম্পদ ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদনের উপাদানগুলিকে একত্রীকরণসহ পল্লী অর্থসংস্থান গ্রামীণ জনগণকে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগদানের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মৌলিক উপায় হিসেবে কাজ করে।
পৌর এলাকাসমূহে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক শাখা এবং সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানের সমারোহ থাকায় সহজে তহবিল সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উৎপাদনবৃদ্ধি এবং জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও পল্লীর দরিদ্র কৃষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে ভোগে। অতীতে পল্লী অঞ্চলে অর্থসংস্থান করার উপায় ও সুযোগ সীমিত এবং পল্লী মূলধন বাজারের চাহিদা ও সরবরাহে ব্যাপক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পল্লী অর্থনীতিতে বিদ্যমান ছিল আর্থিক সম্পদ বিক্রেতা ও ক্রেতার ব্যাপক উপস্থিতি। পল্লী অর্থবাজারের ‘মার্কেট-মেকার’ বা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পল্লিবাসী ব্যক্তিবর্গ, পরিবার, কৃষি খামার এবং অন্যান্য অ-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। পল্লী অর্থবাজারগুলি অংশগ্রহণকারী, তহবিলের উৎস, পরিমাণ এবং চাহিদা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন রকমের ছিল। বাজারগুলির সাংগঠনিক কাঠামো, ব্যবস্থাপনা এবং ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা সম্পর্কও ছিল নানামুখী।
অপ্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান পল্লী অর্থবাজারে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ভূস্বামী, প্রতিবেশী, দোকানমালিক, কৃষক, কারুশিল্পী, ফেরিওয়ালা, বাজারজাতকরণে নিয়োজিত মধ্যস্থতাকারী, গ্রাম্য মহাজন এবং অন্যান্য স্থানীয় আয় উপার্জনকারী গ্রুপগুলির মধ্যে সংঘঠিত হওয়ার মাধ্যমে সম্পদ ও তহবিলের হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলে। পৌর এলাকাতেও অনানুষ্ঠানিক আর্থিক বাজার রয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের অনুপস্থিতি বা স্বল্প উপস্থিতির কারণেই সেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থবাজার গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আনুষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান প্রক্রিয়া কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও পল্লী অর্থবাজারের অনানুষ্ঠানিক অংশটি কোন প্রকার আইনগত বা আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই দীর্ঘকাল থেকে অর্থ ও তহবিল লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থানের উৎসগুলি হচ্ছে, ক. পেশাদার মহাজন, খ. কৃষিঋণ দাতা বা দাদনকারী, গ. ব্যবসায়িক এজেন্ট, ঘ. আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং বিভিন্ন আত্মকর্ম-সংস্থানকারী পেশাজীবী সমিতি ও সেবা গ্রুপ, ঙ. হিতাকাঙ্ক্ষী ধনী ব্যক্তিবর্গ, চ. দোকানদার, বাজার-মধ্যস্থতাকারী এবং প্রতিষ্ঠান মালিক।
প্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান পল্লী অর্থবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক অংশে তহবিল সরবরাহ অথবা ঋণপ্রদানকারী সংগঠনগুলির মধ্যে সমবায় সমিতি, বাণিজ্যিক, সমবায় ও বিশেষায়িত ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও গ্রুপ, কৃষিপণ্য বাজারজাতকারী সমবায় সমিতিসমূহ, জমি বন্ধকী ব্যাংক এবং কৃষিসহ অন্যান্য খাতে ঋণদানকারী সরকারি এজেন্সি উল্লেখযোগ্য। সমবায় সমিতিগুলি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান করে। পল্লীঋণ বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক অংশটি সাধারণভাবে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত বাজার। এ বাজারের প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরিবীক্ষণ করা হয়। ঋণ প্রাপ্তির জন্য প্রতিপালনীয় নিয়মাচার, সুদের হার, জামানত প্রথা ইত্যাদির ফলে পল্লীর একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এ সকল আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে এদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম পল্লীর কৃষক ও পেশাজীবীদের মাত্র একাংশের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পল্লী আর্থিক বাজারের প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির গ্রামীণ শাখাসমূহ, কিছু বেসরকারি ব্যাংকের সীমিতসংখ্যক গ্রামীণ শাখা, সমবায় ব্যাংক ও সমবায় সমিতিসমূহ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য বিশেষায়িত ব্যাংক ও সংস্থাসমূহ। কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে তহবিল প্রবাহ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা হয়। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি, গ্রামীণ ব্যাংক, স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি এবং এনজিওসমূহ উল্লেখযোগ্য।
পল্লী অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ বা অর্থসংস্থানের পদ্ধতি ব্রিটিশ শাসনামলে উদ্ভূত হয়। ১৭০০ সালে কলকাতায় হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল ব্যাংক যা ছিল এ অঞ্চলে প্রথম ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আধুনিক ঋণ ও অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলে ১৪টি ব্যাংক কার্যরত ছিল এবং এগুলি ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, দিনাজপুর, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। এসব ব্যাংক ব্যতীত ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৭টি ঋণ অফিস কার্যরত ছিল। এ ঋণ অফিসগুলি হচ্ছে ফরিদপুর (স্থাপিত ১৮৬৫), বগুড়া (১৮৭২), বরিশাল (১৮৭৩), ময়মনসিংহ (১৮৭৩), নাছিরাবাদ (১৮৭৫), যশোর (১৮৭৬), মুন্সিগঞ্জ (১৮৭৬), ঢাকা (১৮৭৮), সিলেট (১৮৮১), পাবনা (১৮৮২), কিশোরগঞ্জ (১৮৮৩), নোয়াখালী (১৮৮৫), খুলনা (১৮৮৭), মাদারীপুর (১৮৮৭), টাঙ্গাইল (১৮৮৭), নীলফামারী (১৮৯৪) এবং রংপুর (১৮৯৪)। এ সকল ঋণ অফিস প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছিল এবং এরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করত। অপরদিকে একই উদ্দেশ্যে ১৯১২ সালে সমবায় সমিতি আইনের অধীনে প্রভিন্সিয়াল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপিত হয়। ১৯৪০ সালে প্রণীত ‘বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট’-এর অধীনে গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও অন্যান্য কার্যক্রমে ঋণ প্রদানার্থে সমবায় সমিতি গঠনের রূপরেখা অনুমোদন করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান ব্রিটিশ প্রশাসন থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে ৬৩১টি ব্যাংক-শাখাবিশিষ্ট একটি দুর্বল ব্যাংকিং কাঠামো লাভ করে। এগুলির মধ্যে বিদেশি ব্যাংকও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্যাংক শাখাগুলির মধ্যে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মাত্র ১৫৯টি শাখা গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির নতুন শাখা খোলাসহ আরও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে দেশে একটি শক্তিশালী ঋণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। বিশেষত পল্লী অর্থসংস্থানের নিমিত্তে গ্রামাঞ্চলে শাখা খোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও ঋণদানকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়। পল্লী ব্যবসায়, শিল্প, কৃষি এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল ঋণদানকারী সংস্থাকে উৎসাহিত করে। এ সময়ে সরকারি ঋণদান সংস্থাগুলির মধ্যে পল্লী অঞ্চলেও কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের বেশকিছু শাখা ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের বরাদ্দকৃত কৃষিঋণ ছিল ২৮ মিলিয়ন রুপি এবং এই ঋণের পরিমাণ ১৯৬১-৬২ সালে দাঁড়ায় ২৫ মিলিয়ন রুপি। কৃষিখাতে সরাসরি ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে তাকাবি ঋণ এবং পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিঋণ কার্যক্রম হাতে নেয়। কোন প্রকার মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত সরকার সরাসরি কৃষকদেরকে ঋণ প্রদান করে। এ সময়ে সমবায় সমিতি এবং সংগঠনসমূহ কৃষিঋণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ব পাকিস্তানের ঋণদান সমবায় সমিতিগুলি কর্তৃক বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ১৯৪৮-৪৯ সালে ছিল ২৭.৫ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ছিল ৪ মিলিয়ন রুপি। কৃষি খাতে অন্যান্য সমবায় সমিতিসমূহ ১৯৪৮-৪৯ সালে ১.৬ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ০.৫ মিলিয়ন টাকা ঋণ প্রদান করে।
১৯৫৯-৬০ সালের শেষে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৮টি জমি বন্ধকী ব্যাংক ছিল। এরা পুরাতন ঋণ পরিশোধ এবং ভূমির স্থায়ী উন্নয়নের জন্য ০.৬৩ মিলিয়ন রুপি ঋণ প্রদান করে। ১৯৪৮-৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ৮৩টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ছিল। এ সকল ব্যাংক কৃষিখাতে একত্রে ১৯৪৮-৪৯ সালে ১৭.৯ মিলিয়ন, ১৯৫৫-৬৫ সালে ১০.৬৪ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ২৮.৮ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করে। সে সময় যেসব অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকগুলি ঋণ দিত না, সেখানে বহুমুখী সমবায় সমিতিসমূহের শাখা কৃষিকাজের জন্য ঋণ প্রদান করত। ১৯৫৯-৬০ সালে এরূপ বহুমুখী সমবায় সমিতির সংখ্যা ছিল ৬২টি এবং ঐ সালে কৃষি খাতে এদের আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ৬.০২ মিলিয়ন রুপি।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে ১২টি ব্যাংকের ১,১৩০টি শাখাসমেত একটি দুর্বল ব্যাংকিং কাঠামো লাভ করে। ১৯৭১-১৯৭৬ সময়ে কৃষিখাতে ঋণদান করার মতো বাংলাদেশে দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিল। এগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (সাবেক কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক) ও সমবায় সমিতিসমূহ। কৃষিখাতে ঋণপ্রবাহ দ্রুত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে একটি বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচি (এসএসিপি) গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় পল্লী অঞ্চলে কৃষিঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে নির্দেশ প্রদান করে। এ নির্দেশানুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের গ্রামীণ শাখা ব্যাপকভাবে তাদের কৃষিঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে। ১৯৭৬-৭৭ সালে দেশের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬০ মিলিয়ন টাকা। ব্যাংক প্রদত্ত কৃষিঋণের পরিমাণ পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮০-৮১ সালে ৩,৭৫০ মিলিয়ন, ১৯৮৪-৮৫ সালে ১১,৫০০ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৬,৩০০ মিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়। ২০১০-১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২৬,০০০ মিলিয়ন টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) মোট ৯৬৮টি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মোট ৩৫৭টি শাখা কৃষিঋণ প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি খাতে ১৯৯৭-৯৮ সালে মোট ৪,৮৯৭ মিলিয়ন, ১৯৯৮-৯৯ সালে ১১,০৬৯ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে ৯,১৭৫ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল। একই খাতে রাকাব ১৯৯৭-৯৮ সালে ১,৫১৭ মিলিয়ন, ১৯৯৮-৯৯ সালে ২,৫০০ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে মোট ২,৬৩৬ মিলিয়ন টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করে।
বাংলাদেশের পল্লী অর্থসংস্থান অর্থায়নে সম্পৃক্ত অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লি (বিএসবিএল), সমবায় জমিবন্ধকী ব্যাংক, কেন্দ্রীয় আখ চাষি সমিতি এবং থানা সমবায় সমিতিসমূহ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক সকল কেন্দ্রীয় কো-অপারেটিভ সোসাইটির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। উপর্যুক্ত সমবায় সমিতিসমূহের যেকোনটি বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের সদস্য হতে পারে। ৩০ জুন ১৯৯৯ তারিখে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫১১টি। ঐ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের (বিএসবিএল) মোট বিতরণকৃত ২৭.৪৩ মিলিয়ন টাকার মধ্যে ২৪.৯৪ মিলিয়ন টাকা কৃষি খাতে বিতরণ করা হয়। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কর্তৃক কৃষিঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার ২০০০ সালে সর্বনিম্ন ৯.৭৫% এবং সর্বোচ্চ ১৫.৫০%-এর মধ্যে ওঠানামা করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী ত্রিশ বছরে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিকেবি এবং রাকাব একত্রে প্রায় ৫০% কৃষিঋণ প্রদান করেছে। অবশিষ্ট ৫০% আসে অনানুষ্ঠানিক ঋণবাজার বা উৎসসমূহ থেকে। সমগ্র দেশে সমন্বিতভাবে কৃষিঋণ বিতরণের জন্য বর্তমানে একটি লিড ব্যাংক স্কিম চালু রয়েছে। এ স্কিমের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিকেবির প্রত্যেক শাখাকে এক বা একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, রাকাব ও বিকেবি দেশের সকল এলাকাকে তাদের ঋণসুবিধার আওতায় আনতে পারে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর কৃষিঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচার করে। ব্যাংকগুলি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত ঐ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণদান নীতিমালার আলোকে নিজস্ব ঋণ প্রদান নীতিমালা প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশে কৃষিঋণ বাজারের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও ভঙ্গুর। কেননা, অধিকাংশ কৃষিঋণ অনুৎপাদনশীল। এর একটি বৃহদাংশ গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী কৃষক এবং এলিট ও টাউটগণ গ্রাস করে ফেলেছে। অপরদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক ঋণ বাজারে চালান হয়ে পুনরায় কৃষকদের নিকট উচ্চহার সুদে বিতরণ করা হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র কৃষক এবং অন্যান্য পেশার লোকজন এ সকল অনানুষ্ঠানিক ঋণের গ্রাহক। এছাড়া এসব ঋণের বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য ক্রয় ও অপরাপর অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। সর্বোপরি, দেশের কৃষিঋণ আদায়ের হার মাত্র ৪২%, যা এ ঋণবাজারের সম্প্রসারণের পথে একটি কঠিন বাধা।
পল্লী অর্থসংস্থানে বিভিন্ন এনজিও সমষ্টিগতভাবে অপর একটি শক্তিশালী আনুষ্ঠানিক তহবিল সরবরাহকারী গ্রুপ। সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যে অংশ ব্যাংক এবং অপরাপর প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ পায় না, সে সকল লোকদের ঋণতহবিল সরবরাহে এনজিওদের ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। কিছু কিছু এনজিও শহুরে দরিদ্রদের মধ্যেও তাদের ঋণদান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থাকে দারিদ্র বিমোচনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এটি দারিদ্র দূরীকরণের অনেকগুলি চালকের মধ্যে একটি মাত্র। সহায়ক সরকারি নীতিমালা, পল্লী অর্থবাজারের ব্যাপ্তি ও কার্যকারিতা এবং অনানুষ্ঠানিক সেবাসমূহের সহজলভ্যতার ওপর পল্লী অর্থসংস্থানের কার্যকর ব্যবহার ও প্রয়োগ নির্ভর করে। আয়বিহীন অতি দরিদ্র জনগণ উন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, আয় স্থানান্তর, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন নীতিমালার প্রণয়ন ও প্রয়োগ দ্বারা সরাসরি উপকৃত হয়ে থাকে। আয়বৈষম্য সৃষ্টি, সম্পদের অনুৎপাদনশীল ও অসম বণ্টন, মাঝারি ও বৃহদাকার ঋণ প্রদানে ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার জন্য পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। গ্রহীতাগণ কর্তৃক তাদের গৃহীত পল্লীঋণের অনুৎপাদনশীল ব্যবহার পল্লী আর্থিক ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পল্লী অর্থসংস্থানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকসমূহ সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকসমূহসহ সকল তফসিলী ব্যাংককে কৃষি ঋণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃষিঋণ বিতরণের জন্য নীতিমালা সহজতর করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যাকসহ কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে লিংকেজ (Linkage) কর্মসূচির আওতায় ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ (Micro-credit) প্রদান কার্যক্রমেও ব্যাংকসমূহ ক্রমবর্ধমান হারে অংশ গ্রহণ করছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ব্যাংকসমূহ ৯৩৭৯.২৩ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করে যার বিপরীতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিতরণকৃত এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১১১৬.৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকসমূহ ছাড়াও সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন (PKSF) এবং এনজিওসমূহ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সমস্ত সংস্থার বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৭৩১.৭৯ কোটি টাকা এবং ঋণ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি। এসব ঋণের সিংহভাগই পল্লী এলাকায় প্রদত্ত যার আদায়ের হার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ।
পল্লী অর্থসংস্থানের জন্য সরকার বাজেটেও প্রতিবছর বর্ধিত হারে বরাদ্দ রেখে আসছে। কৃষকদের সহায়তা প্রদানের জন্য সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ৪২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (SME) খাত উন্নয়নসহ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম ও পরিচালনা করে আসছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত এসব ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১,৬২৮.২৩ কোটি টাকা ও আদায়ের পরিমাণ ৫২,০২১.০২ কোটি টাকা।
পল্লী তহবিল বা পল্লী ঋণ গ্রহিতাদের সম্পদ ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদনের উপাদানগুলিকে একত্রীকরণসহ পল্লী অর্থসংস্থান গ্রামীণ জনগণকে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগদানের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মৌলিক উপায় হিসেবে কাজ করে।
পৌর এলাকাসমূহে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক শাখা এবং সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানের সমারোহ থাকায় সহজে তহবিল সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উৎপাদনবৃদ্ধি এবং জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও পল্লীর দরিদ্র কৃষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে ভোগে। অতীতে পল্লী অঞ্চলে অর্থসংস্থান করার উপায় ও সুযোগ সীমিত এবং পল্লী মূলধন বাজারের চাহিদা ও সরবরাহে ব্যাপক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পল্লী অর্থনীতিতে বিদ্যমান ছিল আর্থিক সম্পদ বিক্রেতা ও ক্রেতার ব্যাপক উপস্থিতি। পল্লী অর্থবাজারের ‘মার্কেট-মেকার’ বা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পল্লিবাসী ব্যক্তিবর্গ, পরিবার, কৃষি খামার এবং অন্যান্য অ-ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। পল্লী অর্থবাজারগুলি অংশগ্রহণকারী, তহবিলের উৎস, পরিমাণ এবং চাহিদা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন রকমের ছিল। বাজারগুলির সাংগঠনিক কাঠামো, ব্যবস্থাপনা এবং ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা সম্পর্কও ছিল নানামুখী।
অপ্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান পল্লী অর্থবাজারে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ভূস্বামী, প্রতিবেশী, দোকানমালিক, কৃষক, কারুশিল্পী, ফেরিওয়ালা, বাজারজাতকরণে নিয়োজিত মধ্যস্থতাকারী, গ্রাম্য মহাজন এবং অন্যান্য স্থানীয় আয় উপার্জনকারী গ্রুপগুলির মধ্যে সংঘঠিত হওয়ার মাধ্যমে সম্পদ ও তহবিলের হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলে। পৌর এলাকাতেও অনানুষ্ঠানিক আর্থিক বাজার রয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের অনুপস্থিতি বা স্বল্প উপস্থিতির কারণেই সেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থবাজার গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আনুষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান প্রক্রিয়া কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও পল্লী অর্থবাজারের অনানুষ্ঠানিক অংশটি কোন প্রকার আইনগত বা আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই দীর্ঘকাল থেকে অর্থ ও তহবিল লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থানের উৎসগুলি হচ্ছে, ক. পেশাদার মহাজন, খ. কৃষিঋণ দাতা বা দাদনকারী, গ. ব্যবসায়িক এজেন্ট, ঘ. আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং বিভিন্ন আত্মকর্ম-সংস্থানকারী পেশাজীবী সমিতি ও সেবা গ্রুপ, ঙ. হিতাকাঙ্ক্ষী ধনী ব্যক্তিবর্গ, চ. দোকানদার, বাজার-মধ্যস্থতাকারী এবং প্রতিষ্ঠান মালিক।
প্রাতিষ্ঠানিক পল্লী অর্থসংস্থান পল্লী অর্থবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক অংশে তহবিল সরবরাহ অথবা ঋণপ্রদানকারী সংগঠনগুলির মধ্যে সমবায় সমিতি, বাণিজ্যিক, সমবায় ও বিশেষায়িত ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও গ্রুপ, কৃষিপণ্য বাজারজাতকারী সমবায় সমিতিসমূহ, জমি বন্ধকী ব্যাংক এবং কৃষিসহ অন্যান্য খাতে ঋণদানকারী সরকারি এজেন্সি উল্লেখযোগ্য। সমবায় সমিতিগুলি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান করে। পল্লীঋণ বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক অংশটি সাধারণভাবে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত বাজার। এ বাজারের প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরিবীক্ষণ করা হয়। ঋণ প্রাপ্তির জন্য প্রতিপালনীয় নিয়মাচার, সুদের হার, জামানত প্রথা ইত্যাদির ফলে পল্লীর একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এ সকল আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে এদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম পল্লীর কৃষক ও পেশাজীবীদের মাত্র একাংশের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পল্লী আর্থিক বাজারের প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির গ্রামীণ শাখাসমূহ, কিছু বেসরকারি ব্যাংকের সীমিতসংখ্যক গ্রামীণ শাখা, সমবায় ব্যাংক ও সমবায় সমিতিসমূহ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য বিশেষায়িত ব্যাংক ও সংস্থাসমূহ। কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এবং উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে তহবিল প্রবাহ সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা হয়। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি, গ্রামীণ ব্যাংক, স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি এবং এনজিওসমূহ উল্লেখযোগ্য।
পল্লী অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ বা অর্থসংস্থানের পদ্ধতি ব্রিটিশ শাসনামলে উদ্ভূত হয়। ১৭০০ সালে কলকাতায় হিন্দুস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল ব্যাংক যা ছিল এ অঞ্চলে প্রথম ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আধুনিক ঋণ ও অর্থসংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলে ১৪টি ব্যাংক কার্যরত ছিল এবং এগুলি ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, দিনাজপুর, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। এসব ব্যাংক ব্যতীত ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৭টি ঋণ অফিস কার্যরত ছিল। এ ঋণ অফিসগুলি হচ্ছে ফরিদপুর (স্থাপিত ১৮৬৫), বগুড়া (১৮৭২), বরিশাল (১৮৭৩), ময়মনসিংহ (১৮৭৩), নাছিরাবাদ (১৮৭৫), যশোর (১৮৭৬), মুন্সিগঞ্জ (১৮৭৬), ঢাকা (১৮৭৮), সিলেট (১৮৮১), পাবনা (১৮৮২), কিশোরগঞ্জ (১৮৮৩), নোয়াখালী (১৮৮৫), খুলনা (১৮৮৭), মাদারীপুর (১৮৮৭), টাঙ্গাইল (১৮৮৭), নীলফামারী (১৮৯৪) এবং রংপুর (১৮৯৪)। এ সকল ঋণ অফিস প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছিল এবং এরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করত। অপরদিকে একই উদ্দেশ্যে ১৯১২ সালে সমবায় সমিতি আইনের অধীনে প্রভিন্সিয়াল কো-অপারেটিভ ব্যাংক স্থাপিত হয়। ১৯৪০ সালে প্রণীত ‘বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট’-এর অধীনে গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও অন্যান্য কার্যক্রমে ঋণ প্রদানার্থে সমবায় সমিতি গঠনের রূপরেখা অনুমোদন করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান ব্রিটিশ প্রশাসন থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে ৬৩১টি ব্যাংক-শাখাবিশিষ্ট একটি দুর্বল ব্যাংকিং কাঠামো লাভ করে। এগুলির মধ্যে বিদেশি ব্যাংকও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্যাংক শাখাগুলির মধ্যে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের মাত্র ১৫৯টি শাখা গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির নতুন শাখা খোলাসহ আরও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে দেশে একটি শক্তিশালী ঋণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। বিশেষত পল্লী অর্থসংস্থানের নিমিত্তে গ্রামাঞ্চলে শাখা খোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও ঋণদানকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়। পল্লী ব্যবসায়, শিল্প, কৃষি এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল ঋণদানকারী সংস্থাকে উৎসাহিত করে। এ সময়ে সরকারি ঋণদান সংস্থাগুলির মধ্যে পল্লী অঞ্চলেও কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের বেশকিছু শাখা ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের বরাদ্দকৃত কৃষিঋণ ছিল ২৮ মিলিয়ন রুপি এবং এই ঋণের পরিমাণ ১৯৬১-৬২ সালে দাঁড়ায় ২৫ মিলিয়ন রুপি। কৃষিখাতে সরাসরি ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে তাকাবি ঋণ এবং পূর্ব পাকিস্তানে কৃষিঋণ কার্যক্রম হাতে নেয়। কোন প্রকার মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত সরকার সরাসরি কৃষকদেরকে ঋণ প্রদান করে। এ সময়ে সমবায় সমিতি এবং সংগঠনসমূহ কৃষিঋণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ব পাকিস্তানের ঋণদান সমবায় সমিতিগুলি কর্তৃক বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ১৯৪৮-৪৯ সালে ছিল ২৭.৫ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ছিল ৪ মিলিয়ন রুপি। কৃষি খাতে অন্যান্য সমবায় সমিতিসমূহ ১৯৪৮-৪৯ সালে ১.৬ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ০.৫ মিলিয়ন টাকা ঋণ প্রদান করে।
১৯৫৯-৬০ সালের শেষে পূর্ব পাকিস্তানে মোট ৮টি জমি বন্ধকী ব্যাংক ছিল। এরা পুরাতন ঋণ পরিশোধ এবং ভূমির স্থায়ী উন্নয়নের জন্য ০.৬৩ মিলিয়ন রুপি ঋণ প্রদান করে। ১৯৪৮-৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ৮৩টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ছিল। এ সকল ব্যাংক কৃষিখাতে একত্রে ১৯৪৮-৪৯ সালে ১৭.৯ মিলিয়ন, ১৯৫৫-৬৫ সালে ১০.৬৪ মিলিয়ন এবং ১৯৫৯-৬০ সালে ২৮.৮ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করে। সে সময় যেসব অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকগুলি ঋণ দিত না, সেখানে বহুমুখী সমবায় সমিতিসমূহের শাখা কৃষিকাজের জন্য ঋণ প্রদান করত। ১৯৫৯-৬০ সালে এরূপ বহুমুখী সমবায় সমিতির সংখ্যা ছিল ৬২টি এবং ঐ সালে কৃষি খাতে এদের আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ৬.০২ মিলিয়ন রুপি।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে ১২টি ব্যাংকের ১,১৩০টি শাখাসমেত একটি দুর্বল ব্যাংকিং কাঠামো লাভ করে। ১৯৭১-১৯৭৬ সময়ে কৃষিখাতে ঋণদান করার মতো বাংলাদেশে দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিল। এগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (সাবেক কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক) ও সমবায় সমিতিসমূহ। কৃষিখাতে ঋণপ্রবাহ দ্রুত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে একটি বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচি (এসএসিপি) গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় পল্লী অঞ্চলে কৃষিঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে নির্দেশ প্রদান করে। এ নির্দেশানুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের গ্রামীণ শাখা ব্যাপকভাবে তাদের কৃষিঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে। ১৯৭৬-৭৭ সালে দেশের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬০ মিলিয়ন টাকা। ব্যাংক প্রদত্ত কৃষিঋণের পরিমাণ পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮০-৮১ সালে ৩,৭৫০ মিলিয়ন, ১৯৮৪-৮৫ সালে ১১,৫০০ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৬,৩০০ মিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়। ২০১০-১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২৬,০০০ মিলিয়ন টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) মোট ৯৬৮টি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মোট ৩৫৭টি শাখা কৃষিঋণ প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি খাতে ১৯৯৭-৯৮ সালে মোট ৪,৮৯৭ মিলিয়ন, ১৯৯৮-৯৯ সালে ১১,০৬৯ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে ৯,১৭৫ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল। একই খাতে রাকাব ১৯৯৭-৯৮ সালে ১,৫১৭ মিলিয়ন, ১৯৯৮-৯৯ সালে ২,৫০০ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে মোট ২,৬৩৬ মিলিয়ন টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করে।
বাংলাদেশের পল্লী অর্থসংস্থান অর্থায়নে সম্পৃক্ত অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লি (বিএসবিএল), সমবায় জমিবন্ধকী ব্যাংক, কেন্দ্রীয় আখ চাষি সমিতি এবং থানা সমবায় সমিতিসমূহ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক সকল কেন্দ্রীয় কো-অপারেটিভ সোসাইটির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। উপর্যুক্ত সমবায় সমিতিসমূহের যেকোনটি বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের সদস্য হতে পারে। ৩০ জুন ১৯৯৯ তারিখে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫১১টি। ঐ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের (বিএসবিএল) মোট বিতরণকৃত ২৭.৪৩ মিলিয়ন টাকার মধ্যে ২৪.৯৪ মিলিয়ন টাকা কৃষি খাতে বিতরণ করা হয়। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কর্তৃক কৃষিঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার ২০০০ সালে সর্বনিম্ন ৯.৭৫% এবং সর্বোচ্চ ১৫.৫০%-এর মধ্যে ওঠানামা করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী ত্রিশ বছরে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিকেবি এবং রাকাব একত্রে প্রায় ৫০% কৃষিঋণ প্রদান করেছে। অবশিষ্ট ৫০% আসে অনানুষ্ঠানিক ঋণবাজার বা উৎসসমূহ থেকে। সমগ্র দেশে সমন্বিতভাবে কৃষিঋণ বিতরণের জন্য বর্তমানে একটি লিড ব্যাংক স্কিম চালু রয়েছে। এ স্কিমের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিকেবির প্রত্যেক শাখাকে এক বা একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, রাকাব ও বিকেবি দেশের সকল এলাকাকে তাদের ঋণসুবিধার আওতায় আনতে পারে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর কৃষিঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচার করে। ব্যাংকগুলি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত ঐ নীতিমালা অনুযায়ী তাদের ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণদান নীতিমালার আলোকে নিজস্ব ঋণ প্রদান নীতিমালা প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশে কৃষিঋণ বাজারের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও ভঙ্গুর। কেননা, অধিকাংশ কৃষিঋণ অনুৎপাদনশীল। এর একটি বৃহদাংশ গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনী কৃষক এবং এলিট ও টাউটগণ গ্রাস করে ফেলেছে। অপরদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক ঋণ বাজারে চালান হয়ে পুনরায় কৃষকদের নিকট উচ্চহার সুদে বিতরণ করা হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র কৃষক এবং অন্যান্য পেশার লোকজন এ সকল অনানুষ্ঠানিক ঋণের গ্রাহক। এছাড়া এসব ঋণের বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য ক্রয় ও অপরাপর অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। সর্বোপরি, দেশের কৃষিঋণ আদায়ের হার মাত্র ৪২%, যা এ ঋণবাজারের সম্প্রসারণের পথে একটি কঠিন বাধা।
পল্লী অর্থসংস্থানে বিভিন্ন এনজিও সমষ্টিগতভাবে অপর একটি শক্তিশালী আনুষ্ঠানিক তহবিল সরবরাহকারী গ্রুপ। সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যে অংশ ব্যাংক এবং অপরাপর প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ পায় না, সে সকল লোকদের ঋণতহবিল সরবরাহে এনজিওদের ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। কিছু কিছু এনজিও শহুরে দরিদ্রদের মধ্যেও তাদের ঋণদান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থাকে দারিদ্র বিমোচনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এটি দারিদ্র দূরীকরণের অনেকগুলি চালকের মধ্যে একটি মাত্র। সহায়ক সরকারি নীতিমালা, পল্লী অর্থবাজারের ব্যাপ্তি ও কার্যকারিতা এবং অনানুষ্ঠানিক সেবাসমূহের সহজলভ্যতার ওপর পল্লী অর্থসংস্থানের কার্যকর ব্যবহার ও প্রয়োগ নির্ভর করে। আয়বিহীন অতি দরিদ্র জনগণ উন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, আয় স্থানান্তর, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উন্নয়ন নীতিমালার প্রণয়ন ও প্রয়োগ দ্বারা সরাসরি উপকৃত হয়ে থাকে। আয়বৈষম্য সৃষ্টি, সম্পদের অনুৎপাদনশীল ও অসম বণ্টন, মাঝারি ও বৃহদাকার ঋণ প্রদানে ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার জন্য পল্লী অর্থসংস্থান ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। গ্রহীতাগণ কর্তৃক তাদের গৃহীত পল্লীঋণের অনুৎপাদনশীল ব্যবহার পল্লী আর্থিক ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পল্লী অর্থসংস্থানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকসমূহ সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকসমূহসহ সকল তফসিলী ব্যাংককে কৃষি ঋণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃষিঋণ বিতরণের জন্য নীতিমালা সহজতর করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যাকসহ কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে লিংকেজ (Linkage) কর্মসূচির আওতায় ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ (Micro-credit) প্রদান কার্যক্রমেও ব্যাংকসমূহ ক্রমবর্ধমান হারে অংশ গ্রহণ করছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ব্যাংকসমূহ ৯৩৭৯.২৩ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করে যার বিপরীতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিতরণকৃত এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১১১৬.৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকসমূহ ছাড়াও সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন (PKSF) এবং এনজিওসমূহ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সমস্ত সংস্থার বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৭৩১.৭৯ কোটি টাকা এবং ঋণ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি। এসব ঋণের সিংহভাগই পল্লী এলাকায় প্রদত্ত যার আদায়ের হার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ।
পল্লী অর্থসংস্থানের জন্য সরকার বাজেটেও প্রতিবছর বর্ধিত হারে বরাদ্দ রেখে আসছে। কৃষকদের সহায়তা প্রদানের জন্য সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ৪২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (SME) খাত উন্নয়নসহ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম ও পরিচালনা করে আসছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিভূত এসব ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১,৬২৮.২৩ কোটি টাকা ও আদায়ের পরিমাণ ৫২,০২১.০২ কোটি টাকা।
[আবুল কালাম আজাদ - বাংলাপিডিয়া]