অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড বাংলাদেশের একটি অন্যতম রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এটি ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি পরিত্যক্ত ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক এবং কমার্স ব্যাংক-এর সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পাদিত ভেন্ডরস চুক্তির মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ১৫ নভেম্বর ২০০৭ থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি রূপে নতুন অভিযাত্রা শুরু করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন উৎসাহ ও অঙ্গীকার নিয়ে দেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে টেকসই ভিতের ওপর দাঁড় করার জন্য অগ্রণী ব্যাংক সকল উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে।
বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সহ মোট ১১ জন পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের সামগ্রিক নীতি নির্ধারণ করে থাকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর প্রধান নির্বাহী এবং তাঁকে দুইজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৭ জন মহাব্যবস্থাপক এবং অন্যান্য নির্বাহী কর্মকর্তারা সহায়তা প্রদান করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট এবং বরিশাল এ ছয়টি প্রশাসনিক বিভাগে ব্যাংকের শাখাগুলির পরিচালনার দায়িত্ব মহাব্যবস্থাপকদের ওপর অর্পিত। ঢাকায় একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং এর প্রধান কার্যালয়ের মোট ২২টি বিভাগ রয়েছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে Enterprise Growth and Bank Modernization Project-এর আওতায় প্রধান কার্যালয়ের ঋণ, নিরীক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি এবং হিসাব এই চার ক্ষেত্রে মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার পরামর্শক নিয়োগ এবং ব্যাংকের জন্য ১ জন সার্বক্ষণিক আইন উপদেষ্টা নিয়োগ এর ব্যবস্থা রয়েছে।
বিভিন্ন হিসাবে আমানত গ্রহণ এবং অর্থনীতির প্রায় সকল খাতে ঋণ প্রদান ছাড়াও ব্যাংকটি স্কুল ব্যাংকিং, ভ্রমণকারীর চেক, অবসর ভাতা তহবিল, শিল্প উন্নয়ন বন্ড এবং অভ্যন্তরীণ অর্থপ্রেরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে। ব্যাংকটি আয়বর্ধক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু প্রকল্প পরিচালনা করে, যেমন উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান প্রকল্প, নেত্রকোনা সমন্বিত কৃষিপণ্য এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, চাকরি সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ইফাদ সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প, জাতীয় ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রকল্প এবং কৃষি বহুমুখীকরণ ও নিবিড়করণ প্রকল্প ইত্যাদি। ব্যাংকটি বহির্বাণিজ্যে অর্থসংস্থান ও রেমিটেন্স সেবাসহ বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত ব্যবসায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের আত্মীয়স্বজন বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধি যাতে দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্স-এর অর্থ স্বল্পতম সময়ে এবং সহজে পেতে পারেন সেই লক্ষ্যে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড দেশজুড়ে গড়ে তুলেছে বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক। এলক্ষ্যে ব্যাংক মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছাড়িয়ে ইতালি পর্যন্ত রেমিট্যান্স কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব ২টি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানসহ ৩২টি বিদেশি ব্যাংক/এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশে সরাসরি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। ৩১ জানুয়ারি ২০০২ তারিখে সিঙ্গাপুরে অগ্রণী এক্সচেঞ্জ হাউস প্রাঃ লিমিটেড নামে একটি এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা হয় যার মাধ্যমে ২০০৮ সালে প্রায় ৫১৪৫ মিলিয়ন টাকা রেমিট্যান্স বাংলাদেশে প্রেরিত হয়। এছাড়া ২১ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে ভূমিপুত্র কমার্স ব্যাংক, বারহাদ, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়ার সাথে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স আহরণের নিমিত্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৫ মার্চ ২০০৪ তারিখ হতে অদ্যাবধি ভূমিপুত্র কমার্স ব্যাংকের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার মে ব্যাংক-এর সাথে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের অর্থ দেশে প্রেরিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে কর্মরত বাংলাদেশীদের অর্থ দ্রুত প্রেরণের লক্ষ্যে অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউস এসডিএম, বিএইচডি চালু আছে। উল্লেখ্য, সরকার ঘোষিত নীতিমালার সাথে সংগতি রেখে রেমিট্যান্সের অন্তর্মুখী প্রবাহ বৃদ্ধিসহ নিরাপদে ও দ্রুততম সময়ে গ্রাহক বা বেনিফিশিয়ারিদের হিসাবে টাকা জমাকরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
২০০৯ পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর ৩৯৮৩টি প্রকল্পের জন্য ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮০৪৩ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক কেবল ২০০৯ সালে ২২৫টি প্রকল্পের অনুকূলে ৪৩১৪ মিলিয়ন টাকা মঞ্জুর করেছে, যার মধ্যে ৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্টও অন্তর্ভুক্তদ্ধ রয়েছে। শিল্প খাতে ব্যাংক প্রদত্ত শিল্প ঋণের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগ দেওয়া হয়েছে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প খাতে এবং অবশিষ্ট ৫২ ভাগ দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে। সরকার ঘোষিত অগ্রাধিকার খাতসহ শিল্পের গুরুতপূর্ণ ৪৪টি উপ-খাতে ব্যাংক অর্থায়ন করেছে।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ১৯৭৭ সাল থেকে সরকারের নীতিমালার আলোকে পল্লী এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠীকে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোতধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল ও উজ্জীবিতকরণসহ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ২৫টি কর্মসূচি/প্রকল্পের মাধ্যমে ১০টি এনজিওসহ ৩২৮০৫৬৩ জন উদ্যোক্তাকে মোট ২৭৩৬৭ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং এ খাতে আদায়ের হার সন্তোষজনক। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট ইউনিট (মেডু) অনুবিভাগকে এসএমই ও মাইক্রো ক্রেডিট বিভাগ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগে রূপান্তর করে দারিদ্র্য বিমোচনে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ১৯৯৫ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ও ইফাদ-এর যৌথ উদ্যোগে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প (ইজিপিআরপি) প্রকল্পটি দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে জুলাই ২০০০ থেকে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে অন্যান্য ৩টি পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকের সাথে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করেছে। বর্তমানে এ বিভাগের আওতাধীনে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্র ব্যবসা সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এনজিওদের ঋণদানসহ ১৪টি ক্ষুদ্রঋণ কর্মস‚ূচ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩টি কর্মসূচি নিম্নরূপ:
গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প .ইজিপিআরপি) ইফাদ ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের অর্থায়নে ১৯৯৫-’৯৬ সাল থেকে জুন ২০০০ সাল পর্যন্ত ইজিপিআরপি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তা বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলো এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য। প্রকল্পের আওতায় জামানতবিহীন ৭৫,০০০ টাকা এবং জামানতসহ সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়। এছাড়া এর আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনদের ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৮৪৮০ জন উদ্যোক্তাকে মোট ৪৫৩৯ মিলিয়ন টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে এ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৫৪৪৩ মিলিয়ন টাকা। পুঞ্জিভূত ঋণ আদায়ের হার শতকরা ৯৭ ভাগ।
প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ২০০৩ সালে এ বিশেষ ঋণ কর্মসূচি চালু করা হয়। প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল স্রোতধারায় একীভূত করার লক্ষ্যে সরকার প্রণীত এ ঋণ কর্মসূচি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শারীরিকভাবে পঙ্গু কিন্তু বুদ্ধিমান ও ব্যবসায় ক্ষেত্রে পারদর্শী প্রতিবন্ধীরা এককভাবে বা পরিবারের কোনো যোগ্য সদস্যের সংগে যৌথভাবে এ ঋণ গ্রহণ করতে পারেন।
মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি মহিলাদের সমাজে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে এ কর্মসূচি শুরু করা হয়। একজন মহিলা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ঋণ পেয়ে থাকেন।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর যাবতীয় কার্যাবলি দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পাদন করার অভিপ্রায়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। শাখা কম্পিউটারাইজেশন-এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক শাখা অটোমেশনে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে LAN-ভিত্তিক শাখা ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ৮৬৭টি শাখার মধ্যে ২৫৮টি শাখাকে সজ্জিত করা হয়েছে। অবশিষ্ট সকল শাখায় কম্পিউটার বিদ্যমান আছে এবং দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক কার্যাদি সম্পাদিত হচ্ছে। ব্যাংকের সকল শাখায় ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত রয়েছে, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক Foreign Remittance পরিশোধ, Circular প্রেরণ ও সকল তথ্যাদি আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যে সকল শাখায় শাখা ব্যাংকিং সফট্ওয়্যার স্থাপন করা হয়নি সে সকল শাখায় ইতোমধ্যে General Ledger Software স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনন্দিন Statement of Affairs, Profit and Loss Accounts সম্পর্কিত তথ্যাদি automated পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হচ্ছে। ২০০২ সালের শেষভাগে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়, যাতে ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সেবা ও পণ্যসহ আর্থিক বিবরণী সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষিত হচ্ছে। ২০০২ সালে E-Cash নামে এটিএম ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। এর মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা নগদ টাকা তোলা ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার সব ধরনের পরিসেবা বিল পরিশোধ করার সুযোগ পাচ্ছেন গ্রাহকবৃন্দ। এটি একটি shared ব্যবস্থা যার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ৮টি সদস্য ব্যাংক। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে সদস্য ব্যাংকগুলোর ৪০টি এটিএম বুথের মাধ্যমে এই সুবিধা চালু রয়েছে। এটিএম-এর সংখ্যা এবং এই সংক্রান্ত অন্যান্য প্রোডাক্ট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ব্যাংকের বিবেচনাধীন রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত লেনদেনের ক্ষেত্রে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের দ্রুততম সেবা নিশ্চিত করার নিমিত্ত ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনকারী বিভিন্ন শাখায় ১৪টি সুইফ্ট স্টেশন চালু রয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সহ মোট ১১ জন পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত। পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের সামগ্রিক নীতি নির্ধারণ করে থাকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর প্রধান নির্বাহী এবং তাঁকে দুইজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৭ জন মহাব্যবস্থাপক এবং অন্যান্য নির্বাহী কর্মকর্তারা সহায়তা প্রদান করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট এবং বরিশাল এ ছয়টি প্রশাসনিক বিভাগে ব্যাংকের শাখাগুলির পরিচালনার দায়িত্ব মহাব্যবস্থাপকদের ওপর অর্পিত। ঢাকায় একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং এর প্রধান কার্যালয়ের মোট ২২টি বিভাগ রয়েছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে Enterprise Growth and Bank Modernization Project-এর আওতায় প্রধান কার্যালয়ের ঋণ, নিরীক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি এবং হিসাব এই চার ক্ষেত্রে মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার পরামর্শক নিয়োগ এবং ব্যাংকের জন্য ১ জন সার্বক্ষণিক আইন উপদেষ্টা নিয়োগ এর ব্যবস্থা রয়েছে।
বিভিন্ন হিসাবে আমানত গ্রহণ এবং অর্থনীতির প্রায় সকল খাতে ঋণ প্রদান ছাড়াও ব্যাংকটি স্কুল ব্যাংকিং, ভ্রমণকারীর চেক, অবসর ভাতা তহবিল, শিল্প উন্নয়ন বন্ড এবং অভ্যন্তরীণ অর্থপ্রেরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা প্রদান করে থাকে। ব্যাংকটি আয়বর্ধক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু প্রকল্প পরিচালনা করে, যেমন উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান প্রকল্প, নেত্রকোনা সমন্বিত কৃষিপণ্য এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, চাকরি সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ইফাদ সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প, জাতীয় ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রকল্প এবং কৃষি বহুমুখীকরণ ও নিবিড়করণ প্রকল্প ইত্যাদি। ব্যাংকটি বহির্বাণিজ্যে অর্থসংস্থান ও রেমিটেন্স সেবাসহ বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত ব্যবসায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের আত্মীয়স্বজন বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধি যাতে দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্স-এর অর্থ স্বল্পতম সময়ে এবং সহজে পেতে পারেন সেই লক্ষ্যে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড দেশজুড়ে গড়ে তুলেছে বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক। এলক্ষ্যে ব্যাংক মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছাড়িয়ে ইতালি পর্যন্ত রেমিট্যান্স কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব ২টি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানসহ ৩২টি বিদেশি ব্যাংক/এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশে সরাসরি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। ৩১ জানুয়ারি ২০০২ তারিখে সিঙ্গাপুরে অগ্রণী এক্সচেঞ্জ হাউস প্রাঃ লিমিটেড নামে একটি এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা হয় যার মাধ্যমে ২০০৮ সালে প্রায় ৫১৪৫ মিলিয়ন টাকা রেমিট্যান্স বাংলাদেশে প্রেরিত হয়। এছাড়া ২১ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে ভূমিপুত্র কমার্স ব্যাংক, বারহাদ, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়ার সাথে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স আহরণের নিমিত্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৫ মার্চ ২০০৪ তারিখ হতে অদ্যাবধি ভূমিপুত্র কমার্স ব্যাংকের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার মে ব্যাংক-এর সাথে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের অর্থ দেশে প্রেরিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে কর্মরত বাংলাদেশীদের অর্থ দ্রুত প্রেরণের লক্ষ্যে অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউস এসডিএম, বিএইচডি চালু আছে। উল্লেখ্য, সরকার ঘোষিত নীতিমালার সাথে সংগতি রেখে রেমিট্যান্সের অন্তর্মুখী প্রবাহ বৃদ্ধিসহ নিরাপদে ও দ্রুততম সময়ে গ্রাহক বা বেনিফিশিয়ারিদের হিসাবে টাকা জমাকরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
২০০৯ পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর ৩৯৮৩টি প্রকল্পের জন্য ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮০৪৩ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক কেবল ২০০৯ সালে ২২৫টি প্রকল্পের অনুকূলে ৪৩১৪ মিলিয়ন টাকা মঞ্জুর করেছে, যার মধ্যে ৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্টও অন্তর্ভুক্তদ্ধ রয়েছে। শিল্প খাতে ব্যাংক প্রদত্ত শিল্প ঋণের মধ্যে শতকরা ৪৮ ভাগ দেওয়া হয়েছে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প খাতে এবং অবশিষ্ট ৫২ ভাগ দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে। সরকার ঘোষিত অগ্রাধিকার খাতসহ শিল্পের গুরুতপূর্ণ ৪৪টি উপ-খাতে ব্যাংক অর্থায়ন করেছে।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ১৯৭৭ সাল থেকে সরকারের নীতিমালার আলোকে পল্লী এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠীকে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোতধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল ও উজ্জীবিতকরণসহ দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ২৫টি কর্মসূচি/প্রকল্পের মাধ্যমে ১০টি এনজিওসহ ৩২৮০৫৬৩ জন উদ্যোক্তাকে মোট ২৭৩৬৭ মিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করেছে এবং এ খাতে আদায়ের হার সন্তোষজনক। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট ইউনিট (মেডু) অনুবিভাগকে এসএমই ও মাইক্রো ক্রেডিট বিভাগ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগে রূপান্তর করে দারিদ্র্য বিমোচনে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ১৯৯৫ সাল থেকে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ও ইফাদ-এর যৌথ উদ্যোগে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প (ইজিপিআরপি) প্রকল্পটি দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে জুলাই ২০০০ থেকে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে অন্যান্য ৩টি পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকের সাথে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করেছে। বর্তমানে এ বিভাগের আওতাধীনে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্র ব্যবসা সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এনজিওদের ঋণদানসহ ১৪টি ক্ষুদ্রঋণ কর্মস‚ূচ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩টি কর্মসূচি নিম্নরূপ:
গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প .ইজিপিআরপি) ইফাদ ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের অর্থায়নে ১৯৯৫-’৯৬ সাল থেকে জুন ২০০০ সাল পর্যন্ত ইজিপিআরপি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তা বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলো এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য। প্রকল্পের আওতায় জামানতবিহীন ৭৫,০০০ টাকা এবং জামানতসহ সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়। এছাড়া এর আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনদের ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৮৪৮০ জন উদ্যোক্তাকে মোট ৪৫৩৯ মিলিয়ন টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে এ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৫৪৪৩ মিলিয়ন টাকা। পুঞ্জিভূত ঋণ আদায়ের হার শতকরা ৯৭ ভাগ।
প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে বিশেষ ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ২০০৩ সালে এ বিশেষ ঋণ কর্মসূচি চালু করা হয়। প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল স্রোতধারায় একীভূত করার লক্ষ্যে সরকার প্রণীত এ ঋণ কর্মসূচি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শারীরিকভাবে পঙ্গু কিন্তু বুদ্ধিমান ও ব্যবসায় ক্ষেত্রে পারদর্শী প্রতিবন্ধীরা এককভাবে বা পরিবারের কোনো যোগ্য সদস্যের সংগে যৌথভাবে এ ঋণ গ্রহণ করতে পারেন।
মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি মহিলাদের সমাজে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে এ কর্মসূচি শুরু করা হয়। একজন মহিলা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা ঋণ পেয়ে থাকেন।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর যাবতীয় কার্যাবলি দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পাদন করার অভিপ্রায়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। শাখা কম্পিউটারাইজেশন-এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক শাখা অটোমেশনে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে LAN-ভিত্তিক শাখা ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ৮৬৭টি শাখার মধ্যে ২৫৮টি শাখাকে সজ্জিত করা হয়েছে। অবশিষ্ট সকল শাখায় কম্পিউটার বিদ্যমান আছে এবং দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক কার্যাদি সম্পাদিত হচ্ছে। ব্যাংকের সকল শাখায় ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত রয়েছে, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক Foreign Remittance পরিশোধ, Circular প্রেরণ ও সকল তথ্যাদি আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যে সকল শাখায় শাখা ব্যাংকিং সফট্ওয়্যার স্থাপন করা হয়নি সে সকল শাখায় ইতোমধ্যে General Ledger Software স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনন্দিন Statement of Affairs, Profit and Loss Accounts সম্পর্কিত তথ্যাদি automated পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হচ্ছে। ২০০২ সালের শেষভাগে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়, যাতে ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সেবা ও পণ্যসহ আর্থিক বিবরণী সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষিত হচ্ছে। ২০০২ সালে E-Cash নামে এটিএম ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। এর মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা নগদ টাকা তোলা ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার সব ধরনের পরিসেবা বিল পরিশোধ করার সুযোগ পাচ্ছেন গ্রাহকবৃন্দ। এটি একটি shared ব্যবস্থা যার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ৮টি সদস্য ব্যাংক। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে সদস্য ব্যাংকগুলোর ৪০টি এটিএম বুথের মাধ্যমে এই সুবিধা চালু রয়েছে। এটিএম-এর সংখ্যা এবং এই সংক্রান্ত অন্যান্য প্রোডাক্ট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ব্যাংকের বিবেচনাধীন রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত লেনদেনের ক্ষেত্রে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের দ্রুততম সেবা নিশ্চিত করার নিমিত্ত ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনকারী বিভিন্ন শাখায় ১৪টি সুইফ্ট স্টেশন চালু রয়েছে।
[মোহাম্মদ আবদুল মজিদ - বাংলাপিডিয়া]