ম্রো একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় এদের অধিক সংখ্যক বসতি রয়েছে। জেলার তোইন, মঙ্গু, তৈনফা, লুলোইং, উত্তরহানগড়, দক্ষিণ হানগড়, তঙ্কাবতী, হরিণঝুড়ি, টেকের পানছড়ি, রেনিখ্যং, পানতলা, থানখ্যং, সোয়ালক, তিনডো, সিংপা, আলীখং এবং ভারিয়াতালি মৌজায় এদের বসবাস। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ম্রোদের মোট সংখ্যা ২২২,১৬৭।
ম্রোরা, ম্রু ও মুরং নামেও পরিচিত। ম্রোদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও পূর্বে বর্ণমালা ছিল না। ইদানীং ম্রোদের নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। ম্রোরা তিববতী-বর্মী গ্রুপের একটি বিশেষ ভাষায় কথা বলে। বতর্মানে এদের নিজস্ব ভাষায় ও বর্ণমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই প্রণীত হয়েছে।
ম্রোরা নিজেদেরকে ‘মারুচা’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ম্রো ভাষায় ‘মারু’ শব্দের অর্থ মানুষ। ম্রো সমাজে কয়েকটি পরিবার মিলে এক একটি গোত্র গঠিত হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত ম্রোদের অনেকগুলি গোত্রের নাম জানা যায়: ঙারুয়া, নাইচাহ, তাম-তু-চাহ, ইয়ম্রে, ঙারিংচাহ্ল তাং, কানবক, প্রেনজু, দেং এবং খউ। একই দল বা গোত্রভুক্ত ছেলেমেয়ের বিয়ে নিষিদ্ধ। ম্রোদের বংশ পরিচয় পিতৃতান্ত্রিক। জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শুষ্ক মৌসুমে সাধারণত ম্রোরা বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
ম্রো ভাষায় কান ফোঁড়ানোকে বলে ‘রইক্ষারাম’। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলকে কান ফোঁড়াতে হয়। এটি করা হয় একটি অনুষ্ঠান এবং ভোজের মাধ্যমে। জুমচাষ শেষে ফসল তোলার পর অবস্থাপন্ন ম্রো পরিবার ছিয়াছত-প্লাই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণত এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ম্রো যুবক-যুবতীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে প্লুং বাঁশির তালে তালে গরুকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করে। এই অনুষ্ঠানে কোনো পুরোহিত থাকে না। বছরে দুবার ম্রোরা পূজা করে। পূজাকে ম্রো ভাষায় খাং বলে। জুমের নতুন ফসলে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি করা হয়। পাড়ায় তিন দিন ধরে এই উৎসব চলে। বছরে দুবার- ফাল্গুন ও আষাঢ় মাসে সারা পাড়ায় তিনদিনব্যাপী কেরাই/কাংনাত পূজা করা হয়। মহামারী আকারে কোনো রোগের প্রাদুভাব হলে তারা বসুমতি পূজা করে।
ম্রো পুরুষরা নেঙটি পরে। একখন্ড কাপড় দুই উরুর মাঝখান দিয়ে কোমরে জড়িয়ে রাখে। মেয়েদের পোশাকের নাম ওয়াঙলাই। মাঝখানে এমব্রয়ডারি করা ওয়াঙলাই-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রস্থ হচ্ছে মাত্র ৬ ইঞ্চি। তারা মাথার পেছনে বামপাশে চুল বাঁধে। পুরুষরা বাজারে যাওয়ার সময় লুঙ্গি ও জামা পরে এবং মেয়েরা শরীরের উপরের অংশে একখন্ড কাপড় পরে নেয়। পুরুষরা লম্বা চুল রাখে এবং কপালের উপর পেঁচিয়ে রাখে।তারা মাথায় পাগড়ি পড়ে। ম্রোরা তাদের শরীর বিভিন্ন রং দিয়ে সাজাতে পছন্দ করে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই তাদের ঠোঁটে রং লাগায়।
নৃত্যের সময় তারা তাদের গাল, ঠোঁট এবং কপাল লাল রঙে রঞ্জিত করতে পছন্দ করে। মেয়েরা মাথায় ও কানে ফুল পরে এবং গলায় পুঁতির মালা পরতে ভালবাসে যেটিকে ম্রো ভাষায় বলা হয় কেংঙঅর। মেয়েদের কানে রূপার বিশেষ অংলংকার (রামচেং) এবং বাহুতে ধাতুনির্মিত বালা পরে। মেয়ে-পুরুষ উভয়ই কানে রিং ব্যবহার করে। বাঁশের পাইপ দিয়ে তারা যে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে তার নাম প্লং। নাচের সময় পুরুষরা লাল কাপড় এবং মাথায় পালক ও পুঁতিসজ্জিত পাগড়ি পরে আর মেয়েরা ফুল, পুঁতি আর মুদ্রা দিয়ে নিজেদের সাজায়।
ম্রো সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতা পরিবারের প্রধান। তবে মেয়েরা সামাজিক জীবনে কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় পুত্র। সম্পত্তির সিংহভাগ পায় কনিষ্ঠ পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে বসবাস করে। একক ও যৌথ উভয় ধরনের পরিবারই ম্রো-দের মধ্যে বিরাজমান। ম্রোরা কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, যেমন ভেঙ্গুয়া (কলাগাছ), প্রেমসেং (মোরগফুল গাছ), কংলাই (বুনো কলাগাছ), মেইজার (কাঁঠাল গাছ), গনারু গ্নর (আমগাছ)। এ থেকে ধারণা করা যায়, ম্রো সমাজে এখানও টোটেমীয় বৃক্ষপূজা প্রচলিত। ম্রো সমাজে দুধরনের বিবাহ দেখা যায়, যেমন ছেলে ও মেয়ে পালিয়ে বিবাহ এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিবাহ। যদি কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে সেক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে যা যা জিনিসপত্র দিয়েছিল সব ফেরত পায়, আর স্ত্রী তার গহনাপাতি পিত্রালয়ে নিয়ে আসে। মেয়েদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে দেখা যায় না, তবে প্রথম স্ত্রী মারা গেলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। বহুবিবাহ বা বহু স্বামী গ্রহণ সমাজে অপ্রচলিত। বাল্যবিবাহও ঘটে কদাচিৎ। ম্রোরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে অথবা মাটি চাপা দেয়। ম্রোদের অর্থনৈতিক জীবন মূলত জুম নির্ভর।
ম্রোরা ধর্মপ্রাণবাদী এবং তাদের তিনজন দেবতা আছে- তুরাই যিনি বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা, সাংতুং অর্থাৎ পাহাড়ের দেবতা এবং ওরেং যিনি নদীর দেবী। কোন কিছু শুরুর আগে ম্রোরা তুরাই-এর নামে শপথ নেয়। সাংতুং-কে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং জুমচাষে ভালো ফসল পাবার আশায় তারা এই পাহাড় দেবতার কাছে প্রার্থনা করে থাকে। গ্রামবাসীদের মঙ্গল কামনায় এবং মহামারী ও অশুভ শক্তিকে বিতাড়নের জন্য তারা দলগতভাবে ওরেং-এর পূজা করে। তারা পরজন্মে বিশ্বাসী নয়। আর তাই তাদের সকল কর্মকান্ড বর্তমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ম্রোদের মতে মৃত্যু হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি। ম্রোদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষণীয়। ম্রোদের একাংশ খ্রিস্টান ধর্মমতে বিশ্বাসী। ম্যানলে নামে এক ম্রো প্রবর্তিত নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’ চালুর পরে বেশ কিছুসংখ্যক লোক এই ধর্মে দীক্ষিত হয়। তবে সবধরনের শপথই নেওয়া হয় বন্দুক, দা এবং বাঘের নামে। তারা সূর্য ও চন্দ্রকে শ্রদ্ধা করে, তবে পূজা করে না। উল্লেখ্য, ম্রোদের কোন ধর্মগুরু নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই এবং কোন মন্দিরও নেই।
ম্রোরা, ম্রু ও মুরং নামেও পরিচিত। ম্রোদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও পূর্বে বর্ণমালা ছিল না। ইদানীং ম্রোদের নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। ম্রোরা তিববতী-বর্মী গ্রুপের একটি বিশেষ ভাষায় কথা বলে। বতর্মানে এদের নিজস্ব ভাষায় ও বর্ণমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই প্রণীত হয়েছে।
মুরং যুবক |
ম্রো ভাষায় কান ফোঁড়ানোকে বলে ‘রইক্ষারাম’। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলকে কান ফোঁড়াতে হয়। এটি করা হয় একটি অনুষ্ঠান এবং ভোজের মাধ্যমে। জুমচাষ শেষে ফসল তোলার পর অবস্থাপন্ন ম্রো পরিবার ছিয়াছত-প্লাই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণত এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ম্রো যুবক-যুবতীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে প্লুং বাঁশির তালে তালে গরুকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করে। এই অনুষ্ঠানে কোনো পুরোহিত থাকে না। বছরে দুবার ম্রোরা পূজা করে। পূজাকে ম্রো ভাষায় খাং বলে। জুমের নতুন ফসলে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি করা হয়। পাড়ায় তিন দিন ধরে এই উৎসব চলে। বছরে দুবার- ফাল্গুন ও আষাঢ় মাসে সারা পাড়ায় তিনদিনব্যাপী কেরাই/কাংনাত পূজা করা হয়। মহামারী আকারে কোনো রোগের প্রাদুভাব হলে তারা বসুমতি পূজা করে।
ম্রো পুরুষরা নেঙটি পরে। একখন্ড কাপড় দুই উরুর মাঝখান দিয়ে কোমরে জড়িয়ে রাখে। মেয়েদের পোশাকের নাম ওয়াঙলাই। মাঝখানে এমব্রয়ডারি করা ওয়াঙলাই-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রস্থ হচ্ছে মাত্র ৬ ইঞ্চি। তারা মাথার পেছনে বামপাশে চুল বাঁধে। পুরুষরা বাজারে যাওয়ার সময় লুঙ্গি ও জামা পরে এবং মেয়েরা শরীরের উপরের অংশে একখন্ড কাপড় পরে নেয়। পুরুষরা লম্বা চুল রাখে এবং কপালের উপর পেঁচিয়ে রাখে।তারা মাথায় পাগড়ি পড়ে। ম্রোরা তাদের শরীর বিভিন্ন রং দিয়ে সাজাতে পছন্দ করে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই তাদের ঠোঁটে রং লাগায়।
নৃত্যের সময় তারা তাদের গাল, ঠোঁট এবং কপাল লাল রঙে রঞ্জিত করতে পছন্দ করে। মেয়েরা মাথায় ও কানে ফুল পরে এবং গলায় পুঁতির মালা পরতে ভালবাসে যেটিকে ম্রো ভাষায় বলা হয় কেংঙঅর। মেয়েদের কানে রূপার বিশেষ অংলংকার (রামচেং) এবং বাহুতে ধাতুনির্মিত বালা পরে। মেয়ে-পুরুষ উভয়ই কানে রিং ব্যবহার করে। বাঁশের পাইপ দিয়ে তারা যে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে তার নাম প্লং। নাচের সময় পুরুষরা লাল কাপড় এবং মাথায় পালক ও পুঁতিসজ্জিত পাগড়ি পরে আর মেয়েরা ফুল, পুঁতি আর মুদ্রা দিয়ে নিজেদের সাজায়।
ম্রো সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতা পরিবারের প্রধান। তবে মেয়েরা সামাজিক জীবনে কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় পুত্র। সম্পত্তির সিংহভাগ পায় কনিষ্ঠ পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে বসবাস করে। একক ও যৌথ উভয় ধরনের পরিবারই ম্রো-দের মধ্যে বিরাজমান। ম্রোরা কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, যেমন ভেঙ্গুয়া (কলাগাছ), প্রেমসেং (মোরগফুল গাছ), কংলাই (বুনো কলাগাছ), মেইজার (কাঁঠাল গাছ), গনারু গ্নর (আমগাছ)। এ থেকে ধারণা করা যায়, ম্রো সমাজে এখানও টোটেমীয় বৃক্ষপূজা প্রচলিত। ম্রো সমাজে দুধরনের বিবাহ দেখা যায়, যেমন ছেলে ও মেয়ে পালিয়ে বিবাহ এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিবাহ। যদি কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে সেক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে যা যা জিনিসপত্র দিয়েছিল সব ফেরত পায়, আর স্ত্রী তার গহনাপাতি পিত্রালয়ে নিয়ে আসে। মেয়েদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে দেখা যায় না, তবে প্রথম স্ত্রী মারা গেলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। বহুবিবাহ বা বহু স্বামী গ্রহণ সমাজে অপ্রচলিত। বাল্যবিবাহও ঘটে কদাচিৎ। ম্রোরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে অথবা মাটি চাপা দেয়। ম্রোদের অর্থনৈতিক জীবন মূলত জুম নির্ভর।
ম্রো কুমুলং (গোবধ) উৎসব |