সাগরকণ্যা কুয়াকাটা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব লীলাভূমি।

প্রাকৃতিক সুন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। কুয়াকাটা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য- যা দেখার জন্য প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায় দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক। এ সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য যে কতটা মনোরম হতে পারে তা লিখে বোঝানো মুশকিল। বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক এই দুর্লভ সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগটা আপনি অনায়াসেই পেতে পারেন কুয়াকাটাতে। স্থানীয় মানুষ আর ভ্রমণপ্রিয়াসীরা কুয়াকাটায় এসে আদর করে ডাকেন সাগরকন্যা বলে। বরিশাল বিভাগের শেষ প্রান্তে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের সর্বশেষ দক্ষিণে অসাধারণ এ সমুদ্র সৈকতটির অবস্থান। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার, প্রস্থ সাড়ে ৩ কিলোমিটার। বর্তমানে সমুদ্রের করাল গ্রাসে প্রশস্ততা কিছুটা কমেছে। কুয়াকাটা পরিচ্ছন্ন সৈকত আর কক্সবাজারের চেয়ে অনেক কম কোলাহল। যারা একটু নিরিবিলি সৈকত পছন্দ করেন তাদের জন্য বেড়ানোর আদর্শ জায়গা কুয়াকাটা। সৈকত ঘেঁষেই আছে সারি সারি নরিকেল বাগান। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ সমুদ্রের ঢেউ। ঢেউগুলো যখন এসে পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে মনে হয় স্নিগ্ধতা আপনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। তখন আপনি নিজের অজান্তেই সমুদ্রে একবার গোসল না করে ফিরতে চাইবেন না। এই সৈকতজুড়ে রয়েছে সাদা ঝিনুকের ছড়াছড়ি। জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে গেলেই দেখতে পাবেন সারি সারি কাঠের বেড আর রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছাতা। ইচ্ছা করলে বেড ভাড়া করে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাবেন। এ ছাড়া দর্শনার্থী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এ সৈকতে আছে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল ও ঘোড়া। বর্ষাকালে সাগর থাকে উত্তাল, ফলে সাগরের সৌন্দর্য হয়ে যায় অন্য রকম। উত্তাল সমুদ্র দেখার মাঝে মিশে থাকে একটি ভয়ের অনুভূতি। কুয়াকাটায় শুধু সমুদ্র সৈকতই নয়, এখানে দেখার মতো আছে আরও অনেক জায়গা।

কুয়াকাটা ইকোপার্ক


সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার জিরোপয়েন্ট থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পূর্বদিকে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত ইকোপার্ক। ৭০০ একর জায়গাজুড়ে এ পার্কটি অবস্থিত। এ পার্কের বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ ও শোভাবর্ধনকারী ৪২ হাজার বৃক্ষ রয়েছে। পার্কের লেকে প্যাডল বোট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বেঞ্চে বসে আড্ডা ও লেকের পাড়ের শেডে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে এখানে। ইকোপার্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে লেক আর ঝাউ বাগান। প্রায় ১ হাজার ফিট দীর্ঘ লেকটি সবাইকে আকৃষ্ট করে। লেকের এক পাশ থেকে অপর পাশে যাওয়ার জন্য একটি সেতু রয়েছে। ইকোপার্কের ঝাউ বাগানের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সাগর থেকে ছুটে আসা ফুরফুরে বাতাস শীতল করে দেয় ভ্রমণপিপাসুদের অন্তর। এই ইকোপার্কে নারিকেল, ঝাউ, আমলকী, অর্জুন, জারুল, হিজল, পেয়ারা, জাম, হরীতকী, কাঠবাদাম, মহুয়া, কামিনি, লালকরমচা, পলাশসহ নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সুশীতল ছায়া দূর করে দেয় জীবনের সব জঞ্জাল। মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন কুয়াকাটা ইকোপার্ক।

গঙ্গামতির চর


কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বদিকে রয়েছে আকর্ষণীয় স্থান গঙ্গামতির চর। গঙ্গমতির চরজুড়ে প্রাণজুড়ানো মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এ চরের মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছ নীল জলধারা আর প্রকৃতির কারুকাজ খচিত বেলাভূমি। প্রকৃতির নিপুণ হাতে গড়া গঙ্গামতির চরের লেক ধরে পর্যটকরা স্পিডবোট, ট্রলার অথবা নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখার মনোরম সুযোগ রয়েছে। খুব সকালে গঙ্গামতি সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার স্বপ্নিল অনুভূতি এনে দেয় এক স্বর্গীয় আবেশ। সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি উচ্ছল করে তোলে অন্তর। বন মোরগের দুরন্তপনা নন্দিত করেছে গঙ্গমতিতে। কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, বাইনসহ নানান প্রজাতির বৃক্ষরাজি রয়েছে এ চরে। কুয়াকাটা জিরোপয়েন্ট থেকে মোটরসাইকেলে যেতে পারেন গঙ্গামতির চরে। গঙ্গামতি যেতে চাইলে অবশ্যই সঙ্গে করে হালকা খাবার ও পানি নিয়ে যাবেন।

ফাতরার বন


ফাতরার বনকে সুন্দরবনের উপবন বলা হয়ে থাকে। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারে ১ ঘণ্টা সাগরের বুকচিরে পশ্চিমে ফাতার বন। সবুজ বনানীর মাঝে অসংখ্য খাল আর কেওরা, সুন্দরী, বাইন, গরান ও গোলপাতাসহ নানা জাতের ম্যানগ্রোভ গাছ ও নাম না জানা হাজার প্রজাতির গাছপালা অপরূপা করেছে ফাতরাকে। দেখে মনে হবে প্রকৃতির সব সবুজ রঙ উজাড় করে সাজিয়েছেন এই বনাঞ্চল! কুয়াকাটা ইকোপার্কের একটি অংশ নির্মিত হচ্ছে এখানে। সাগরপথে ফাতরা বনে গিয়ে প্রমোদ তরীতে ফাতরায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহ্যের ‘ফাতরা ক্যাম্প’ এই গহিন জঙ্গলে স্থাপিত হয়েছিল। অতিথি পাখিদের কোলাহল যে কাউকেই মুহূর্তের জন্য নিয়ে যাবে অন্য এক ভুবনে। এই বন ভ্রমণে যেতে হলে আপনাকে নৌপথে যেতে হবে। বনে যাওয়ার জন্য কয়েকটি ট্যুরিস্ট বোট আছে। ট্যুরিস্ট বোটে যাওয়া-আসার ভাড়া নেবে জনপ্রতি ২০০ টাকা।

শুঁটকি পল্লী


কুয়াকাটার জিরোপয়েন্ট থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। জেলেরা বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা মাছ শুঁটকি করে থাকে। ইলিশ, রূপচাঁদা, লইটা, লোপসা, ভোলা, ছুড়ি, হাঙ্গর, শাপলাসহ অসংখ্য প্রকৃতির মাছ এখানে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। প্রথমে সাগর থেকে ধরে আনা মাছ কাটা হয়। তারপর লবণ দিয়ে তা মাচার উপরে রোদে শুকানো হয়। তিন থেকে চার রোদ শুকালে মাছগুলো ভালোভাবে শুঁটকি হয়। শুঁটকি মাছের এই প্রক্রিয়াজাতকরণ দেখতে ভালো লাগবে। কুয়াকাটা থেকে তৈরি করা শুঁটকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে রফতানি হয় এই শুঁটকি। এখান থেকে বাড়ির জন্য তাজা শুঁটকি নিয়ে আসতে পারেন। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ দেখতে মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে শুঁটকি পল্লীতে আসতে পারেন। শুঁকটি পল্লীর কাছেই রয়েছে লেবুর চর। এ চরের আয়তন ১ হাজার একরের মতো। চিংড়ি ও রেণু শিকারিদের অনেক আবাদ গড়েছে এ চরে।

কুয়াকাটা বৌদ্ধবিহার


এ মন্দিরের ভেতরে ৩ ফুট বেদির ওপরে অষ্টধাতু নির্মিত ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধ মূর্তি, যার ওজন সাড়ে ৩৭ মণ। প্রাচীন নির্মাণশৈলী আর স্থাপৈত্য সৌন্দর্য বজায় রেখে এ মন্দির নির্মিত হয়েছে। এ মন্দিরটি অষ্টধাতুর মন্দির নামে পরিচিত। এই বৌদ্ধবিহারটি জিরোপয়েন্টের পূর্ব পাশে অবস্থিত। বৌদ্ধবিহারের পাশেই রয়েছে ২০০ বছরের প্রাচীন কুয়া। কুয়াটিকে কিছুটা আধুনিকতার রূপ দেয়া হয়েছে। কুয়া থেকে সরাসরি পাকা সিঁড়ি উঠে গেছে বৌদ্ধ মন্দিরের দরজা পর্যন্ত। বেশির ভাগ সময় এ বিহারের দরজা খোলা থাকে পর্যটকদের দেখার জন্য। মূর্তির দিকে তাকালে আপনার চোখ কিছুতেই নামাতে পারবেন না। চারদিকে ফুলের বাগান। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে কাছ থেকে দেখে সংরক্ষণের জন্য ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারেন। এই বিহারটি উপরিভাগ চূড়ার মতো নকশা করা। বিহারটিতে প্রবেশে কোনো টাকা লাগে না। বিহারের পাশেই রয়েছে রাখাইন মার্কেট। এখানে রাখাইনদের হাতে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, বিছানার চাদর থেকে পুঁতির মালা পর্যন্ত সবই পাওয়া যায়। কুয়াকাটা জিরোপয়েন্ট থেকে পাঁচ মিনিটের পথ বৌদ্ধবিহার।

মিশ্রি পাড়ার রাখাইন বৌদ্ধমূর্তি


দেশের সর্ববৃহৎ পাথরের নির্মিত বৌদ্ধমূর্তি কুয়াকাটা মিশ্রি পাড়ায় অবস্থিত। কুয়াকাটা থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর কোণে মিশ্রিপাড়া গ্রাম। প্রায় ৭০ মণ ওজনের বৌদ্ধমূর্তিটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর উচ্চতা প্রায় ৩৬ ফুট। এখানকার মন্দিরটিও সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের স্টাইলে নির্মিত। মন্দিরটি ২০০ বছরের পুরনো। মন্দিরের গা ঘেঁষেই রয়েছে রাখাইনদের একটি পাড়া। সেখানে ঘুরে দেখতে পারেন রাখাইনদের তৈরি কাপড় বুনানোর দৃশ্য এবং তাদের জীবনযাত্রা। এখানে প্রতি বছর রাস পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমায় উৎসব হয়ে থাকে।

সোনার চর


সাগরে জেগে ওঠা এ দ্বীপের আয়তন প্রায় ১০ বর্গমাইল। রুপালি বালুর ওপর অসংখ্য লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি সারা দিন। শ্বাসমূলের বন আছে দ্বীপে। ভোরের সূর্য লাল আলো ছড়িয়ে দেয় বেলাভূমিতে, তখন মনে হয় কেউ অসংখ্য আলো জ্বেলে দিয়েছে সাগরের বুকে। দ্বীপের শরীরজুড়ে অনেক খাল ছড়িয়ে আছে। দ্বীপটির পূর্ব প্রান্তে আছে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে চরমন্তাজ যেতে হয়। এই চর থেকে খেয়া নৌকায় সোনারচর যাওয়া যায়। এ ছাড়া পটুয়াখালী থেকে গলাচিপা হয়ে লঞ্চে সোনার চরে যাওয়া যায়। ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে।

কীভাবে যাবেন


ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটার দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। ঢাকার সায়েদাবাদ ও গাবতলীর বাস টার্মিনাল থেকে সাকুরা, সুগন্ধা, মেঘনা ও আবদুল্লাহ পরিবহনে সরাসরি আসতে পারেন কুয়াকাটায়। ভাড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। সময় লাগবে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। এ ছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায় বিআরটিসি বাস। ঢাকা আসার বাস সন্ধ্যা ৬টায় কুয়াকাটা থেকে ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে নদীপথেও কুয়াকাটা যাওয়া যায়। নদীপথে যাত্রা আরামদায়ক। নদীপথে যেতে চাইলে সে ক্ষেত্রে সদরঘাট থেকে নির্ধারিত রুটে লঞ্চযোগে প্রথমে পটুয়াখালী কিংবা কলাপাড়া আসতে হবে। পটুয়াখালী থেকে আপনার তিনটি ফেরি পার হতে হবে। তারপর ভাড়া করা মাইক্রোবাস অথবা পটুয়াখালী-কুয়াকাটা রুটের বাসে চড়ে সোজা পৌঁছে যাবেন কুয়াকাটা। ঢাকা থেকে লঞ্চ বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। লঞ্চে কেবিন ভাড়া ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা।

কোথায় থাকবেন


থাকার জন্য কুয়াকাটায় বেশ কয়েকটি আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে ভালো মানের হোটেল হচ্ছে পর্যটন কর্পোরেশনের পর্যটন হোটেল। বেসরকারি মালিকানাধীন হোটেল রয়েছে- হোটেল কুয়াকাটা ইন, কুয়াকাটা গেস্ট হাউস, হোটেল নীলাঞ্জনা ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল স্কাই, গেভার-ইন, খোশ ইন্টারন্যাশনাল, সাগরকন্যা রিসোর্ট ইত্যাদি। খরচ পড়বে ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। এ ছাড়া কুয়াকাটার বাঁধের পাশে রাস্তার দুই পাশে আরও অনেক হোটেল পাবেন। আপনার সুবিধামতো যে কোনো একটিতে উঠতে পারেন। এ ছাড়া এখানে দুটি সরকারি ডাকবাংলো আছে। একটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের, অপরটি এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।