বন্ড বাজার যেকোন ধরনের বন্ডের মালিকানা হস্তান্তর সংক্রান্ত লেনদেন কার্যাবলি ও এসব লেনদেনের স্থান। ১৯৭১ সালের পূর্বে তহবিল বা সম্পদ সংগ্রহের উপায় হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে বন্ডের প্রচলন ছিল না। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের হাতে থাকা পাকিস্তান সরকারের আয়কর ও প্রতিরক্ষা বন্ডসমূহের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে সেগুলিকে বাংলাদেশ সরকারের বন্ড হিসেবে নতুনভাবে ইস্যু করে। এতদ্ব্যতীত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শেয়ারহোল্ডারগণের অনুকূলেও সরকার ৫% অহস্তান্তরযোগ্য বন্ড ইস্যু করে। অপরদিকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে অচল ঘোষিত ১০০ টাকার নোটসমূহের মূল্য পরিশোধের জন্য অর্থসংস্থানের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৪ সালে সঞ্চয় বন্ড চালু করে। এ সকল সঞ্চয় বন্ডের অধিকাংশ বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রয় ও ধারণ করে।
দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড চালু করে ও বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের নিকট সেগুলি বিক্রয়ে উদ্যোগী হয়। পরবর্তীকালে ব্যক্তিবিশেষ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকগুলির নিকট বিক্রয়ের জন্য সরকার ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে দুই বছর মেয়াদি বিশেষ ট্রেজারি বন্ড এবং অব্যাংকিং বিনিয়োগকারীদের নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় বিনিয়োগ বন্ড নামে অপর একটি বন্ড চালু করে।
গত শতকের ৮০-এর দশকে দেশের বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ি ও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সকল মেয়াদোত্তীর্ণ ও শ্রেণিবিন্যাসকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মূলধন ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে সরকারি খাতের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানও অর্থসংকটে পড়ে। এমতাবস্থায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃমূলধনায়ন এবং সংকটাপন্ন এ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দায় অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সরকার তাদের অনুকূলে বিরাট অঙ্কের বন্ড ইস্যু করে। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যেও সরকার তাদের অনুকূলে কিছু বন্ড ইস্যু করে। উপরন্তু, বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড, বাংলাদেশ বিমান ইত্যাদি সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিছু বন্ড চালু করা হয়েছিল।
১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে যেসব বন্ড ইস্যু করেছে সেগুলির তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইস্যুকৃত মোট ৩৩টি বন্ডের মধ্যে ১৭টিই ৩ বছর মেয়াদি এবং এগুলি ইস্যু করার উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, পাট খাতের লোকসান পুনর্ভরণ, টেলিফোন খাতের উন্নয়ন, পাট ও বস্ত্র খাতের উন্নয়ন ইত্যাদি। ২ বছর মেয়াদি একটি মাত্র ইস্যুকৃত বন্ডের উদ্দেশ্য ছিল মওকুফকৃত কৃষিঋণ পুনর্ভরণ। তিনটি ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানের অর্থসংস্থানের উদ্দেশ্যে। ১০ বছর মেয়াদি বন্ড ছিল তিনটি যার দুটিই ছিল পাট খাতে অর্থসংস্থানের জন্য। অপরটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ক্ষতি পুনর্ভরণ। তিনটি ১৫ বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃমূলধনায়ন, অনাদায়ি ঋণের জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ এবং মওকুফকৃত কৃষিঋণের অর্থ পুনর্ভরণের ব্যবস্থা করে। ২৫ বছর মেয়াদি তিনটি ট্রেজারি বন্ডই ইস্যু করার উদ্দেশ্য ছিল পাট খাতের অবসায়ন। এ সকল ট্রেজারি বন্ড ছাড়া ইস্যুকৃত বাকি তিনটি বন্ডের মধ্যে দুটি ছিল সুদমুক্ত ট্রেজারি বন্ড এবং একটি ছিল বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহের অনুকূলে ইস্যুকৃত মেয়াদি বন্ড।
বাংলাদেশে বন্ড বাজারের আকার অত্যন্ত সীমিত এবং এখানে বন্ডসমূহ ক্রয়-বিক্রয়ের কোন সুযোগ নেই। ইস্যুকৃত অধিকাংশ বন্ড রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্তৃক ক্রয় ও ধারণ করা হয়েছে। খুবই স্বল্পসংখ্যক বন্ড বিশেষায়িত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলি ক্রয় এবং ধারণ করছে। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেও কিছু বন্ড রয়েছে। ফলে এরাই বাংলাদেশের বন্ড বাজারের প্রধান ক্রেতা এবং সংগঠক। সরকার এ সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ দিয়ে তাদের জন্য বন্ড ক্রয় বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিধিবদ্ধ সম্পদ হিসেবেও বাধ্যতামূলকভাবে বন্ড ক্রয় ও ধারণ করতে হয়। ইস্যুকৃত এ সকল বন্ডের মধ্যে অধিকাংশই হস্তান্তরযোগ্য নয়। মাধ্যমিক বাজার না থাকায় বন্ড হোল্ডারগণকে সেগুলির নগদায়নের জন্য বন্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
ক্রয় বিক্রয়ের জন্য ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ খুবই সীমিত আকারে বাজারজাতকরণ হয়। ইস্যুকৃত এ সব বন্ডের ধারক ব্যাংকসমূহের অধিকাংশই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক। ব্যক্তি এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসব বন্ড ধারণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মেয়াদপূর্তী কাঠামো এবং সুদহারের অনমনীয়তার কারণে তাদের সাড়া ছিল খুবই কম। মূলত সরকারের বণ্টন ব্যবস্থা এবং নুন্যতম বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকসমূহ এসব ধারণ করতো। বস্ত্ততপক্ষে এটার বিপণন একটা আবদ্ধ বাজারে সীমাবদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং অ-নিবাসী বাংলাদেশিদের যারা লাভলোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের জন্য ২০০৪ সালে অক্টোবর মাসে ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ বন্ড চালু করা হয়। স্বল্প মেয়াদি এবং আকর্ষণীয় নমনীয় হারের কারণে ৬ মাস, ১ বছর ও ২ বছর মেয়াদি এসব বন্ড বিনিয়োগকারীদের নিকট খুব আকর্ষণীয় হয়।
সরকারের ব্যয় কর্মসূচিতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণের হাতিয়ার হিসেবে ৬ মাস অন্তর প্রদেয় কুপনরেটভিত্তিক ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর মেয়াদি গভর্ণমেন্ট ট্রেজারি বন্ড (BGTB) প্রবর্তন করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে এসব বন্ড ঈল্ডের ভিত্তিতে অভিহিত মূল্যে প্রতিটি এককের গুণিতকহারে ইস্যু করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে এবং নিবাসী প্রতিষ্ঠানসমূহও এসব বন্ড ক্রয় করতে পারে।
অ-নিবাসী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানও এসব বন্ড ক্রয় করতে পারে। কিন্তু, ১ বছরের মধ্যে ক্রয়কৃত বন্ড বিক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয় না। সরকারের অর্থ সংগ্রহের কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কাট অফ মূল্যে এসব বন্ড ইস্যু করে। প্রতি আর্থিক বছরের শুরুতে ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশল হিসেবে ঘোষিত ঋণ পঞ্জিকা অনুযায়ী বন্ডের নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। অবলেখক ও বাজার সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রাইমারি ডিলারগণ নিলামে অংশগ্রহণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিলামের জন্য নির্ধারিত অংক অবিক্রিত থাকলে তা প্রাইমারি ডিলাদের মধ্যে ডিভলভড (Devolved) করা হয়। প্রাইমারি ইস্যু হিসেবে বিক্রিত বন্ড নিলামে নির্ধারিত হার এবং ইস্যুর তারিখ থেকে ৬ মাস অন্তর প্রদেয় কুপনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু করা হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চলতি হিসাব সংরক্ষণ করে তারা নিজেরা তাদের হিসাবে অথবা অন্যের পক্ষে বন্ডের অভিহিত মূল্যে প্রতিটি ১ লক্ষ টাকার জন্য অথবা তার গুণিতক ভাবে বিড প্রদান করে। ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদি বন্ডের জন্য আলাদাভাবে বিড প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ডের ঈল্ড চিত্রের (yield curve) কাঙ্খিত অবস্থা বজায় রাখার জন্য অবিক্রিত অংশের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নিলামে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি মার্কেটেও অংশগ্রহণ করে। বাজারে অংশগ্রহণকারীদের সুযোগদানের পর বাজারের উন্নতি এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থান গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের বেচা-কেনা শুরু। বাজারে বেচাকেনার জন্য ঢাকা স্টক এক্সেঞ্জে মোট ১৮টি বন্ড তালিকাভূক্ত হয়। উল্লেখ্য যে দেশের বন্ড বাজার উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইমারি ডিলার নিয়োগ করেছে এবং এখন পর্যন্ত ১২টি ডিলার নিলামে ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ মুক্তভাবে বেচাকেনা করছে। প্রাইমারি ডিলারগণ তহবিল স্বল্পতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়।
যেহেতু সরকার বন্ড মার্কেট থেকে একমাত্র ঋণ গ্রহণকারী সুতরাং বন্ড মার্কেটের ঈল্ড চিত্রের অবস্থা সরকারের অন্য সঞ্চয় মাধ্যমে প্রদত্ত সুদ হারের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি এবং মেয়াদপূর্তির সময়কাল বিবেচনায় সরকারের অন্যান্য সঞ্চয় মাধ্যমগুলির সুদহারের তুলনামূলক বিচারে বাজারে ইস্যুকৃত বন্ডের ঈল্ড কর্ম। এটা উচ্চ ঝুঁকি উচ্চ আয়-এ প্রচলিত নিয়মের বিপরীত অবস্থা যা দেশের বন্ড বাজারের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি বন্ড বাজারের সুদের নিম্নহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা দীর্ঘ মেয়াদ শেষে ঈল্ড রেখাচিত্রকে সমান্তরাল করবে। এ অবস্থা প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতিকে স্থিরকরণে সহায়ক হবে। ২০০৯ সালের জুন শেষে সকল মেয়াদি বন্ডের কুপন রেট হ্রাস পেয়ে শতকরা ৯.২০ থেকে শতকরা ১৩.০৭ ভাগে দাঁড়ায় যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে শতকরা ১০.৬০ থেকে ১৫.৯৫ ভাগে ছিল।
বন্ড বাজারের এতোসব অগ্রগতি সত্ত্বেও কর্পোরেট বন্ডের অনুপস্থিতির কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বন্ড বাজারের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। একটি স্পন্দনশীল কর্পোরেট বন্ড বাজারের উপস্থিতি ব্যাংক ঋণের উপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্ভরশীলতা হ্রাসে শক্তিশালী ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া এটা অর্থের প্রকৃত বিকল্প মূল্য প্রতিফলনপূর্বক দেশের সুদহারের প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো গড়ে তোলে।
দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড চালু করে ও বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের নিকট সেগুলি বিক্রয়ে উদ্যোগী হয়। পরবর্তীকালে ব্যক্তিবিশেষ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকগুলির নিকট বিক্রয়ের জন্য সরকার ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে দুই বছর মেয়াদি বিশেষ ট্রেজারি বন্ড এবং অব্যাংকিং বিনিয়োগকারীদের নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় বিনিয়োগ বন্ড নামে অপর একটি বন্ড চালু করে।
গত শতকের ৮০-এর দশকে দেশের বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ি ও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সকল মেয়াদোত্তীর্ণ ও শ্রেণিবিন্যাসকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মূলধন ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে সরকারি খাতের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানও অর্থসংকটে পড়ে। এমতাবস্থায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃমূলধনায়ন এবং সংকটাপন্ন এ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দায় অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সরকার তাদের অনুকূলে বিরাট অঙ্কের বন্ড ইস্যু করে। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যেও সরকার তাদের অনুকূলে কিছু বন্ড ইস্যু করে। উপরন্তু, বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড, বাংলাদেশ বিমান ইত্যাদি সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিছু বন্ড চালু করা হয়েছিল।
১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে যেসব বন্ড ইস্যু করেছে সেগুলির তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইস্যুকৃত মোট ৩৩টি বন্ডের মধ্যে ১৭টিই ৩ বছর মেয়াদি এবং এগুলি ইস্যু করার উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, পাট খাতের লোকসান পুনর্ভরণ, টেলিফোন খাতের উন্নয়ন, পাট ও বস্ত্র খাতের উন্নয়ন ইত্যাদি। ২ বছর মেয়াদি একটি মাত্র ইস্যুকৃত বন্ডের উদ্দেশ্য ছিল মওকুফকৃত কৃষিঋণ পুনর্ভরণ। তিনটি ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানের অর্থসংস্থানের উদ্দেশ্যে। ১০ বছর মেয়াদি বন্ড ছিল তিনটি যার দুটিই ছিল পাট খাতে অর্থসংস্থানের জন্য। অপরটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ক্ষতি পুনর্ভরণ। তিনটি ১৫ বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃমূলধনায়ন, অনাদায়ি ঋণের জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ এবং মওকুফকৃত কৃষিঋণের অর্থ পুনর্ভরণের ব্যবস্থা করে। ২৫ বছর মেয়াদি তিনটি ট্রেজারি বন্ডই ইস্যু করার উদ্দেশ্য ছিল পাট খাতের অবসায়ন। এ সকল ট্রেজারি বন্ড ছাড়া ইস্যুকৃত বাকি তিনটি বন্ডের মধ্যে দুটি ছিল সুদমুক্ত ট্রেজারি বন্ড এবং একটি ছিল বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহের অনুকূলে ইস্যুকৃত মেয়াদি বন্ড।
বাংলাদেশে বন্ড বাজারের আকার অত্যন্ত সীমিত এবং এখানে বন্ডসমূহ ক্রয়-বিক্রয়ের কোন সুযোগ নেই। ইস্যুকৃত অধিকাংশ বন্ড রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্তৃক ক্রয় ও ধারণ করা হয়েছে। খুবই স্বল্পসংখ্যক বন্ড বিশেষায়িত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলি ক্রয় এবং ধারণ করছে। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেও কিছু বন্ড রয়েছে। ফলে এরাই বাংলাদেশের বন্ড বাজারের প্রধান ক্রেতা এবং সংগঠক। সরকার এ সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ দিয়ে তাদের জন্য বন্ড ক্রয় বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিধিবদ্ধ সম্পদ হিসেবেও বাধ্যতামূলকভাবে বন্ড ক্রয় ও ধারণ করতে হয়। ইস্যুকৃত এ সকল বন্ডের মধ্যে অধিকাংশই হস্তান্তরযোগ্য নয়। মাধ্যমিক বাজার না থাকায় বন্ড হোল্ডারগণকে সেগুলির নগদায়নের জন্য বন্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
ক্রয় বিক্রয়ের জন্য ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ খুবই সীমিত আকারে বাজারজাতকরণ হয়। ইস্যুকৃত এ সব বন্ডের ধারক ব্যাংকসমূহের অধিকাংশই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক। ব্যক্তি এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসব বন্ড ধারণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মেয়াদপূর্তী কাঠামো এবং সুদহারের অনমনীয়তার কারণে তাদের সাড়া ছিল খুবই কম। মূলত সরকারের বণ্টন ব্যবস্থা এবং নুন্যতম বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকসমূহ এসব ধারণ করতো। বস্ত্ততপক্ষে এটার বিপণন একটা আবদ্ধ বাজারে সীমাবদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং অ-নিবাসী বাংলাদেশিদের যারা লাভলোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের জন্য ২০০৪ সালে অক্টোবর মাসে ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ বন্ড চালু করা হয়। স্বল্প মেয়াদি এবং আকর্ষণীয় নমনীয় হারের কারণে ৬ মাস, ১ বছর ও ২ বছর মেয়াদি এসব বন্ড বিনিয়োগকারীদের নিকট খুব আকর্ষণীয় হয়।
সরকারের ব্যয় কর্মসূচিতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণের হাতিয়ার হিসেবে ৬ মাস অন্তর প্রদেয় কুপনরেটভিত্তিক ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর মেয়াদি গভর্ণমেন্ট ট্রেজারি বন্ড (BGTB) প্রবর্তন করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে এসব বন্ড ঈল্ডের ভিত্তিতে অভিহিত মূল্যে প্রতিটি এককের গুণিতকহারে ইস্যু করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে এবং নিবাসী প্রতিষ্ঠানসমূহও এসব বন্ড ক্রয় করতে পারে।
অ-নিবাসী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানও এসব বন্ড ক্রয় করতে পারে। কিন্তু, ১ বছরের মধ্যে ক্রয়কৃত বন্ড বিক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয় না। সরকারের অর্থ সংগ্রহের কর্মসূচি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কাট অফ মূল্যে এসব বন্ড ইস্যু করে। প্রতি আর্থিক বছরের শুরুতে ঋণ ব্যবস্থাপনার কৌশল হিসেবে ঘোষিত ঋণ পঞ্জিকা অনুযায়ী বন্ডের নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। অবলেখক ও বাজার সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রাইমারি ডিলারগণ নিলামে অংশগ্রহণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিলামের জন্য নির্ধারিত অংক অবিক্রিত থাকলে তা প্রাইমারি ডিলাদের মধ্যে ডিভলভড (Devolved) করা হয়। প্রাইমারি ইস্যু হিসেবে বিক্রিত বন্ড নিলামে নির্ধারিত হার এবং ইস্যুর তারিখ থেকে ৬ মাস অন্তর প্রদেয় কুপনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু করা হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চলতি হিসাব সংরক্ষণ করে তারা নিজেরা তাদের হিসাবে অথবা অন্যের পক্ষে বন্ডের অভিহিত মূল্যে প্রতিটি ১ লক্ষ টাকার জন্য অথবা তার গুণিতক ভাবে বিড প্রদান করে। ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদি বন্ডের জন্য আলাদাভাবে বিড প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ডের ঈল্ড চিত্রের (yield curve) কাঙ্খিত অবস্থা বজায় রাখার জন্য অবিক্রিত অংশের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নিলামে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি মার্কেটেও অংশগ্রহণ করে। বাজারে অংশগ্রহণকারীদের সুযোগদানের পর বাজারের উন্নতি এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থান গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের বেচা-কেনা শুরু। বাজারে বেচাকেনার জন্য ঢাকা স্টক এক্সেঞ্জে মোট ১৮টি বন্ড তালিকাভূক্ত হয়। উল্লেখ্য যে দেশের বন্ড বাজার উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইমারি ডিলার নিয়োগ করেছে এবং এখন পর্যন্ত ১২টি ডিলার নিলামে ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ মুক্তভাবে বেচাকেনা করছে। প্রাইমারি ডিলারগণ তহবিল স্বল্পতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়।
যেহেতু সরকার বন্ড মার্কেট থেকে একমাত্র ঋণ গ্রহণকারী সুতরাং বন্ড মার্কেটের ঈল্ড চিত্রের অবস্থা সরকারের অন্য সঞ্চয় মাধ্যমে প্রদত্ত সুদ হারের উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি এবং মেয়াদপূর্তির সময়কাল বিবেচনায় সরকারের অন্যান্য সঞ্চয় মাধ্যমগুলির সুদহারের তুলনামূলক বিচারে বাজারে ইস্যুকৃত বন্ডের ঈল্ড কর্ম। এটা উচ্চ ঝুঁকি উচ্চ আয়-এ প্রচলিত নিয়মের বিপরীত অবস্থা যা দেশের বন্ড বাজারের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি বন্ড বাজারের সুদের নিম্নহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা দীর্ঘ মেয়াদ শেষে ঈল্ড রেখাচিত্রকে সমান্তরাল করবে। এ অবস্থা প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতিকে স্থিরকরণে সহায়ক হবে। ২০০৯ সালের জুন শেষে সকল মেয়াদি বন্ডের কুপন রেট হ্রাস পেয়ে শতকরা ৯.২০ থেকে শতকরা ১৩.০৭ ভাগে দাঁড়ায় যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে শতকরা ১০.৬০ থেকে ১৫.৯৫ ভাগে ছিল।
বন্ড বাজারের এতোসব অগ্রগতি সত্ত্বেও কর্পোরেট বন্ডের অনুপস্থিতির কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বন্ড বাজারের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। একটি স্পন্দনশীল কর্পোরেট বন্ড বাজারের উপস্থিতি ব্যাংক ঋণের উপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্ভরশীলতা হ্রাসে শক্তিশালী ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া এটা অর্থের প্রকৃত বিকল্প মূল্য প্রতিফলনপূর্বক দেশের সুদহারের প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো গড়ে তোলে।
[সৈয়দ আহমেদ খান এবং আবদুস সামাদ সরকার - বাংলাপিডিয়া]