খুমি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে বসবাসকারী একটি নৃগোষ্ঠী। আদিতে এরা পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাস শুরু করে। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, খুমি জনগোষ্ঠী মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানছি, বোয়াংছড়ি, লামা ছাড়াও মায়ানমারের আরাকানে এদের বসবাস রয়েছে। ডব্লিউ. ডব্লিউ হান্টারের বর্ণনানুযায়ী এরা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে পার্বত্যাঞ্চলে এসে বসবাস করছে। ১৯১৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুমিদের সংখ্যা ১,২৪১ জন।
শারীরিক কাঠামোর দিক থেকে খুমিরা মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত। গায়ের রং ফর্সা, নাক অনুউচ্চ, চোখ ছোট আকৃতির, পায়ের গোড়ালি ও ঊরু কিঞ্চিৎ মোটা। পুরুষদের থুঁতনীতে অল্প দাঁড়ি। খুমিরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। বসবাসের জন্যে এরা পাহাড়ের উপর বাসগৃহ নির্মাণ করে। পাহাড়ি বাঁশ, কোরকপাতার উপকরণ দিয়ে বাসগৃহ তৈরি করে। তবে তারা গাছের ডালেও ঘর নির্মাণ করে। তারা সমাজে একজন দলপতি মনোনীত করে। সকলেই দলপতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পোষণ করে। সমাজে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে। রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল এবং বোমাং রাজার অধীনস্থ। খুমি সমাজে দুটি দল আছে। এরা হলো: আওয়া এবং আফিয়া।
খুমিদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। বংশ পরম্পরায় তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে আসছে। এটি দক্ষিণাঞ্চলীয় তিববতি বর্মণ ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। খুমি ভাষায় ‘খা’ অর্থ মানুষ এবং ‘মী’ অর্থ উত্তম। অর্থাৎ খামি অর্থ উত্তম মানুষ। খামি কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে খুমি হয়েছে।
পিতৃতান্ত্রিক পরিবারভুক্ত সমাজে এরা গোত্রকে প্রাধান্য দেয়। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় সমগোত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবশ্য বিবাহপূর্ব অবস্থায় ছেলে মেয়ের মেলামেশায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। বিবাহের পূর্বে শুভাশুভ পরীক্ষা করা হয় একটি মোরগ হত্যা করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে জাঁকজমকভাবে ভোজের আয়োজন করা হয়। এদের সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ নেই।
ভাত খুমিদের প্রধান খাদ্য। খুমিরা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। জুম চাষের মাধ্যমে ধান, মরিচ, কাঁকরল, তামাক পাতা, হলুদ, আদা, শাকসবজি প্রভৃতি উৎপাদন করে। তবে ইদানিং তারা আম, কলা ইত্যাদি ফলের চাষও করছে। শিকারে প্রাপ্ত জীবজন্তুর মাংস তাদের উপাদেয় খাদ্য। কুকুরের মাংসও এরা খায়। চাল থেকে তারা চোলাই মদ তৈরি করে এবং সকলেই মদ পানে অভ্যস্থ। এছাড়া তারা তামাকপাতা, চুরুট খেয়ে থাকে। এদের রয়েছে নিজস্ব ধরনের হস্তশিল্পজাত উপকরণ। বাঁশ, বেত কাঠজাতীয় সামগ্রী দিয়ে (পিঠে বহন করার ঝুড়ি) নানা ধরনের পাত্র তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়। বর্তমানে কিছু এনজিওর প্রচেষ্টায় খুমিদের মধ্যে লেখাপড়ার আগ্রহ বেড়েছে। অনেকেই পড়াশুনা করে চাকরিতে প্রবেশ করছে।
মেয়েরা নিজেদের তৈরি কাপড় এবং পুরুষেরা নেংটি পরিধান করেন। পুরুষেরা নেংটির কিছু অংশ ঝুলিয়ে রাখেন। বিভিন্ন উৎসবে এরা নিজস্ব ঐতিহ্যের পোশাক পরিধান করে। খুমিদের ব্যবহূত পোশাক পরিচ্ছদ নিজস্ব তাঁতে তৈরি। খুমি যুবতীরা গলায় বিভিন্ন ধরনের পুঁতির মালা, হাতে কুচি খারু (রুইত), নি-ধা ও ছাংকা পরিধান করেন। এরা রূপা, পুঁতি, তামা ও পিতল দিয়ে অলংকার তৈরি করে। এসব অলংকার দিয়ে খুমি রমনীরা নিজেদেরকে সাজায়।
নতুন শিশুর আগমন খুমি পরিবারে শুভ হিসেবে দেখা হয়। প্রসূতিকালীন সময় থেকে প্রসবকালীন সময় পর্যন্ত খুমি মহিলাদেরকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিন অতিবাহিত করতে হয়। শিশুর জন্মের পরে নাভি শুকানোর পর শিশুর নামকরণ করা হয়। অতীতের পূর্ব পুরুষের নামে সাধারণত নাম রাখা হয়। খুমি সমাজে বালক বালিকা ও শিশুদের কান ছিদ্র করা হয়। অল্প বয়সে চুল কেটে শিশুদের সামাজিকীকরণ করা হয়। কেউ মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যে মরদেহ চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত ঘরে রাখা হয়। এ সময় ঢাকঢোল বাজানো হয়। তাদের ধারণা এতে মৃতের কষ্ট লাঘব হবে। পরে মৃতদেহ দাহ করা হয়। দেহভস্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ সংগ্রহ করে রাখা হয় চিতার পাশে নির্মিত ঘরে। তাদের ধারণা মৃতের আত্মা একদিন আসবে। মৃত্যুর এক বছর পর অন্তিম ভোজের ব্যবস্থা করা হয়।
খুমিরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হলেও প্রকৃতিবাদ ও জড়বাদের অস্তিত্ব তাদের ধর্মে লক্ষণীয়। এরা পাথর, পাহাড়, ঝরনা, নদীকে দেবতাজ্ঞানে পূজা ছাড়াও পাথিয়ান (সৃষ্টিকর্তা)সহ প্রাণদেবতা ও জল দেবতার পূজা করে। প্রতিবেশী স্নেহক্রামা ধর্মের অনুসারী হয়ে অনেক খুমি বর্তমানে ক্রামা ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে। জল দেবতার পূজা বছরের প্রায়সময় অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম দেবতার পূজা শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। বছরে এরা দু’বার নবান্ন পূজার অনুষ্ঠান করে। ফসল ফলনের উদ্দেশ্যে এবং ভাল ফসল প্রাপ্তির পর এরা নবান্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের মধ্যে ‘লামনাহ’ নামক নৃত্যের প্রচলন রয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ই এ নাচে অংশ গ্রহণ করে। ‘চারানাহ’ নামক বিজয়ের নৃত্য যুবকরা বাদ্যের তালে নাচে। মৃতদেহের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময়ও তাদের বিশেষ ধরনের নাচের প্রচলন আছে। নাচের সময় তারা বাদ্যযন্ত্র আলং ও আতং বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। তাদের সমাজে রয়েছে মুখে মুখে প্রচলিত লোককথা ও লোককাহিনী। খুমিরা বর্ষ-বিদায় অনুষ্ঠান ও নববর্ষ উদযাপন করে থাকে পহেলা বৈশাখে। এদিনে এরা নিজেদের সাজায় পাহাড়ি ফুল দিয়ে।
সুদীর্ঘকাল থেকে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত খুমিরা সংখ্যার দিক থেকে পরিমাণে কম হলেও তারা নিজস্ব ঐতিহ্যে অটুট। অতীতে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় দাস ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন, নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, পোশাক-পরিচ্ছদ, নৃত্য-গীত, সমাজ ব্যবস্থা প্রভৃতি তাদের সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ।
খুমি নারী |
খুমিদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও বর্ণমালা নেই। বংশ পরম্পরায় তারা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে আসছে। এটি দক্ষিণাঞ্চলীয় তিববতি বর্মণ ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। খুমি ভাষায় ‘খা’ অর্থ মানুষ এবং ‘মী’ অর্থ উত্তম। অর্থাৎ খামি অর্থ উত্তম মানুষ। খামি কালক্রমে রূপান্তরিত হয়ে খুমি হয়েছে।
পিতৃতান্ত্রিক পরিবারভুক্ত সমাজে এরা গোত্রকে প্রাধান্য দেয়। তাদের সমাজ ব্যবস্থায় সমগোত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবশ্য বিবাহপূর্ব অবস্থায় ছেলে মেয়ের মেলামেশায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। বিবাহের পূর্বে শুভাশুভ পরীক্ষা করা হয় একটি মোরগ হত্যা করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে জাঁকজমকভাবে ভোজের আয়োজন করা হয়। এদের সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ নেই।
ভাত খুমিদের প্রধান খাদ্য। খুমিরা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। জুম চাষের মাধ্যমে ধান, মরিচ, কাঁকরল, তামাক পাতা, হলুদ, আদা, শাকসবজি প্রভৃতি উৎপাদন করে। তবে ইদানিং তারা আম, কলা ইত্যাদি ফলের চাষও করছে। শিকারে প্রাপ্ত জীবজন্তুর মাংস তাদের উপাদেয় খাদ্য। কুকুরের মাংসও এরা খায়। চাল থেকে তারা চোলাই মদ তৈরি করে এবং সকলেই মদ পানে অভ্যস্থ। এছাড়া তারা তামাকপাতা, চুরুট খেয়ে থাকে। এদের রয়েছে নিজস্ব ধরনের হস্তশিল্পজাত উপকরণ। বাঁশ, বেত কাঠজাতীয় সামগ্রী দিয়ে (পিঠে বহন করার ঝুড়ি) নানা ধরনের পাত্র তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়। বর্তমানে কিছু এনজিওর প্রচেষ্টায় খুমিদের মধ্যে লেখাপড়ার আগ্রহ বেড়েছে। অনেকেই পড়াশুনা করে চাকরিতে প্রবেশ করছে।
মেয়েরা নিজেদের তৈরি কাপড় এবং পুরুষেরা নেংটি পরিধান করেন। পুরুষেরা নেংটির কিছু অংশ ঝুলিয়ে রাখেন। বিভিন্ন উৎসবে এরা নিজস্ব ঐতিহ্যের পোশাক পরিধান করে। খুমিদের ব্যবহূত পোশাক পরিচ্ছদ নিজস্ব তাঁতে তৈরি। খুমি যুবতীরা গলায় বিভিন্ন ধরনের পুঁতির মালা, হাতে কুচি খারু (রুইত), নি-ধা ও ছাংকা পরিধান করেন। এরা রূপা, পুঁতি, তামা ও পিতল দিয়ে অলংকার তৈরি করে। এসব অলংকার দিয়ে খুমি রমনীরা নিজেদেরকে সাজায়।
নতুন শিশুর আগমন খুমি পরিবারে শুভ হিসেবে দেখা হয়। প্রসূতিকালীন সময় থেকে প্রসবকালীন সময় পর্যন্ত খুমি মহিলাদেরকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিন অতিবাহিত করতে হয়। শিশুর জন্মের পরে নাভি শুকানোর পর শিশুর নামকরণ করা হয়। অতীতের পূর্ব পুরুষের নামে সাধারণত নাম রাখা হয়। খুমি সমাজে বালক বালিকা ও শিশুদের কান ছিদ্র করা হয়। অল্প বয়সে চুল কেটে শিশুদের সামাজিকীকরণ করা হয়। কেউ মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যে মরদেহ চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত ঘরে রাখা হয়। এ সময় ঢাকঢোল বাজানো হয়। তাদের ধারণা এতে মৃতের কষ্ট লাঘব হবে। পরে মৃতদেহ দাহ করা হয়। দেহভস্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ সংগ্রহ করে রাখা হয় চিতার পাশে নির্মিত ঘরে। তাদের ধারণা মৃতের আত্মা একদিন আসবে। মৃত্যুর এক বছর পর অন্তিম ভোজের ব্যবস্থা করা হয়।
খুমিরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হলেও প্রকৃতিবাদ ও জড়বাদের অস্তিত্ব তাদের ধর্মে লক্ষণীয়। এরা পাথর, পাহাড়, ঝরনা, নদীকে দেবতাজ্ঞানে পূজা ছাড়াও পাথিয়ান (সৃষ্টিকর্তা)সহ প্রাণদেবতা ও জল দেবতার পূজা করে। প্রতিবেশী স্নেহক্রামা ধর্মের অনুসারী হয়ে অনেক খুমি বর্তমানে ক্রামা ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে। জল দেবতার পূজা বছরের প্রায়সময় অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম দেবতার পূজা শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। বছরে এরা দু’বার নবান্ন পূজার অনুষ্ঠান করে। ফসল ফলনের উদ্দেশ্যে এবং ভাল ফসল প্রাপ্তির পর এরা নবান্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের মধ্যে ‘লামনাহ’ নামক নৃত্যের প্রচলন রয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ই এ নাচে অংশ গ্রহণ করে। ‘চারানাহ’ নামক বিজয়ের নৃত্য যুবকরা বাদ্যের তালে নাচে। মৃতদেহের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময়ও তাদের বিশেষ ধরনের নাচের প্রচলন আছে। নাচের সময় তারা বাদ্যযন্ত্র আলং ও আতং বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। তাদের সমাজে রয়েছে মুখে মুখে প্রচলিত লোককথা ও লোককাহিনী। খুমিরা বর্ষ-বিদায় অনুষ্ঠান ও নববর্ষ উদযাপন করে থাকে পহেলা বৈশাখে। এদিনে এরা নিজেদের সাজায় পাহাড়ি ফুল দিয়ে।
সুদীর্ঘকাল থেকে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত খুমিরা সংখ্যার দিক থেকে পরিমাণে কম হলেও তারা নিজস্ব ঐতিহ্যে অটুট। অতীতে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় দাস ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন, নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, পোশাক-পরিচ্ছদ, নৃত্য-গীত, সমাজ ব্যবস্থা প্রভৃতি তাদের সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া