বৈদেশিক সাহায্য ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশ

বৈদেশিক সাহায্য ব্যবস্থাপনা দেশের উন্নয়নের জন্য প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা, সমন্বয়ন, ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন। দাতা দেশগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ধরন ও পরিমাণের ওপর গ্রহীতা দেশের উপান্তিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এ ধরনের সাহায্যের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে গ্রহীতা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবস্থাপনার প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো : (ক) অনুমোদন প্রক্রিয়া ও বৈদেশিক সাহায্যের জন্য আলাপ আলোচনার ধরন; (খ) সাহায্যের সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি; (গ) বাস্তবায়ন, যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। বৈদেশিক সাহায্য দেশের অর্থনীতির কোন কোন খাতে ব্যয় হবে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দাতা দেশ ও সংস্থা সহ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ, পরিকল্পনা কমিশন, ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মতো মুখ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান সুস্পষ্ট ভূমিকা পালন করে।

বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা, সমন্বয় সাধন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, খোদ সাহায্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে না; বরং এই সাহায্য ব্যবস্থাপনা কতটা কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয় তার ওপরই প্রধানত সাহায্যের সদ্ব্যবহার নির্ভর করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে।

আলাপ আলোচনার পদ্ধতি  ১৯৯৯ সালের শেষদিক পর্যন্ত ৩৫টি দাতা দেশ ও বহুমুখী সংস্থা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের (ইউ.এন.ডি.পি) ১৬টি সংস্থা বাংলাদেশকে কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে। বাংলাদেশকে প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য ব্যবস্থাপনা ঢাকাভিত্তিক মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউ.এস.এ.আই.ডি) কর্তৃক পরিচালিত হয়। এ সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের জন্য মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারণ করে এবং সরকারের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ চালায়। এ.আই.ডি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে দেশের পাঁচসালা পরিকল্পনায় নির্ধারিত লক্ষ্য বিবেচনায় রেখে সরকার পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছয়। আলাপ আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে উন্নয়ন প্রকল্পগুলির পর্যালোচনা ও অনুমোদন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন।

অনুমোদন প্রক্রিয়া  বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ই.আর.ডি) মাধ্যমে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে প্রকল্পে অর্থসংস্থানের অনুরোধ জানায়। কোনো প্রকল্পে সাহায্যদানে ইচ্ছুক দাতা সংস্থাগুলো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নিকট প্রস্তাব পাঠায়। একজন সচিবের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বৈদেশিক সাহায্যের জন্য আলোচনা কার্যক্রম প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে। ১৯৭৮ সালে পরিকল্পনা কমিশন থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে পৃথক করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের মর্যাদা দেওয়ার পর এই পরিষদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং দাতা দেশগুলোর সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য লাভের বিষয় আলাপ আলোচনার ক্ষমতা লাভ করে। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার সুষ্ঠু প্রকল্প ব্যবস্থাপনার নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে। ইতোপূর্বে উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহের সমীক্ষা ও অনুমোদনের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল প্রধানত পরিকল্পনা কমিশনের ওপর। চলতি ব্যবস্থার আওতায় সংশ্লিষ্ট  প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো প্রকল্প পরীক্ষা করে এবং পরিশেষে এগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। প্রকল্প অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থা প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের পূর্বসম্মতিক্রমে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করে।

বৈদেশিক সাহায্যের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ কয়েকটি উইং, শাখা ও উপশাখা নিয়ে গঠিত। এ বিভাগ পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত সকল বিবরণী প্রণয়নের দায়িত্ব পালন এবং পরে দাতা ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে এগুলোর ফলাফল সমন্বিত করে। দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা বা মন্ত্রণালয়কে তা অবহিত করে এবং শেষোক্ত প্রতিষ্ঠান ওই প্রকল্পের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চালায়। কোনো কোনো সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের প্রণীত কোনো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা মন্ত্রণালয় ছাড়াই দাতা সংস্থাগুলো প্রকল্প চিহ্নিত ও প্রণয়ন করে।

সাহায্য গ্রহণেচ্ছু প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনের নির্ধারিত ছকে প্রকল্প ধারণাপত্র, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রফর্মা প্রস্ত্তত করে এবং এতে থাকে প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ, ব্যয়ের মূলনীতি ও সময়সূচি। দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নিজস্ব দলিলপত্র প্রণয়ন করে। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রকল্পধারণাপত্র ও কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রফর্মা পাঠায়। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এবং প্রকল্পে অর্থসংস্থানের জন্য দাতা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানায়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাওয়ার পর দাতা প্রতিষ্ঠান কার্যনির্বাহী সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রকল্পপত্র তৈরি করে এবং সেটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ তথা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়।

চূড়ান্ত অনুমোদনের পর দাতা প্রতিষ্ঠান ঋণ/মঞ্জুরি চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করে এবং খসড়াটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নিকট জমা দেয় এবং এই বিভাগ এ খসড়ার অনুলিপি অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে পর্যালোচনা ও পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করে। এসব মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ঋণ/মঞ্জুরি চুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন সম্পর্কে দাতা সংস্থাকে অবহিত করে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তারিখ নির্ধারণ করে। পণ্য সহায়তার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদন প্রয়োজনীয় নয়। জরুরি পরিস্থিতিতে অধিকতর প্রত্যক্ষ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় অর্থাৎ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দাতা দেশগুলোকে সরাসরি অনুরোধ জানান হয়।

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া  প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বিভাগ ও অধিদপ্তরের মতো অধস্তন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিরল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও সরাসরি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নকালীন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করার দায়িত্ব পালন করে।

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্ট সমস্যাবলি মোকাবিলার জন্য সরকার কিছু কার্যপদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। এগুলো হলো : (ক) তহবিল বিমুক্তি এবং পণ্য ও পরিসেবা সংগ্রহের পদ্ধতি সরলীকরণ; (খ) প্রকল্প পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের কাছে ক্ষমতা অর্পণ; (গ) বাস্তবায়ন পরিবীক্ষন ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো শক্তিশালীকরণ; (ঘ) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) নিয়মিত প্রকল্প পুনরীক্ষণ সভার আয়োজন।

মূল্যায়ন প্রক্রিয়া   বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের দায়িত্বও পালন করে। খোদ দাতাদের তরফ থেকেও বার্ষিক ভিত্তিতে প্রকল্পের অগ্রগতি ও কাজ মূল্যায়নের একটি পদ্ধতি রয়েছে। অবশ্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও চলতি ও সমাপ্ত প্রকল্পের মূল্যায়নে দাতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিজ নিজ বিশেষজ্ঞের ওপর নির্ভর করে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দাতা প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষক দ্বারা অনুপুঙ্খ হিসাব নিরীক্ষণ।

মনিটরিং পদ্ধতি  যেকোন দেশে মনিটরিং ব্যবস্থা বৈদেশিক সাহায্য ব্যবস্থাপনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, একনেক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থা কর্তৃক মনিটরিং ব্যবস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের মনিটরিং কাজ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের উভয়ক্ষেত্রেই করা হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো অভ্যন্তরীণ এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ বাইরের মনিটরিং সম্পন্ন করে। বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় বা সংস্থা প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত উভয় বিষয়ে মেয়াদি প্রতিবেদন তৈরি ও পেশ করে এবং সমস্যা মোকাবেলার বিভিন্ন কৌশলের প্রস্তাব উত্থাপন করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এককভাবে মাসিক পর্যালোচনা বৈঠকেরও আয়োজন করে যেখানে প্রকল্পের অগ্রগতি নির্ধারণের জন্য পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা তথ্যাদি লেনদেন করেন। পরিশেষে, একনেক দ্বিবার্ষিক ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে। উন্নয়ন প্রকল্পের অসন্তোষজনক সমাপ্তির কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রণালয়/সংস্থাকে একনেক-এর নিকট প্রতিবেদন পেশ করতে হয়।
[কামাল উদ্দিন আহমদ - বাংলাপিডিয়া]